দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম মাসেই বড় সাফল্যের একটি মূল্যস্ফীতি কমানো। অস্থির জুলাইয়ে যা পৌঁছায় গত ১৩ বছরের সর্বোচ্চ। আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হ্রাসের পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। খাদ্য মূল্যস্ফীতি আগের মাসের চেয়ে প্রায় ৩ শতাংশ পয়েন্ট কমে ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশে নেমেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এক মাসের ব্যবধানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিকের দিকে যাওয়া ও চাঁদাবাজি বন্ধ হওয়া বড় ভূমিকা রেখেছে।
বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার মাত্র ২৫ দিনেরও কম সময়ে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার এমন তথ্য দেয় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
বিবিএস হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, আগস্টে সাধারণ মূল্যস্ফীতি কমে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, জুলাইয়ে যা ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ২ দশমিক ৭৪ শতাংশীয় পয়েন্ট কমে ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশে নেমেছে, আগের মাসে তা ছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। তবে সাধারণ ও খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমলেও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়েছে। জুলাইয়ের ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ থেকে বেড়ে তা ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ সময় শহরের তুলনায় গ্রামে বেশি ছিল সব ধরনের মূল্যস্ফীতির হার।
এক মাসের ব্যবধানে মূল্যস্ফিতি কমার সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, যে মূল্যস্ফীতি কমেছে এটা নির্দিষ্ট নয়। আবার যে বাড়তে পারবে না- এটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। দেশের মানুষকে তিন থেকে চার মাস অপেক্ষা করতে হবে। আমরা সার্বিকদিক অবজার্ভ করছি। মূল্যস্ফীতি কমেছে এটা ভালো খবর। তবে ১০ এর উপরে মূল্যস্ফীতি এটাও তুলনা মূলকভাবে বেশি।
জুলাইয়ের কারফিউ ও আন্দোলনের প্রভাবে সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হওয়ায় নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।
ডেইলি বাংলাদেশকে তিনি বলেন, জুলাই মাসে দেশের অর্থনীতি সংকটের মধ্যে দিয়ে পার করেছে। তখন বাজারে অবস্থা খুব খারাপ ছিল। আগস্টে এসে অর্থনীতি কিছুটা উন্নত হয়েছে। প্রথম দুই সপ্তাহে চাঁদাবাজি বন্ধ ছিল। তবে এখন তা ফিরে আসছে বলে শুনছি। চাঁদাবাজি বন্ধ হওয়ায় খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি হার কমেছে। এতে করে জুলাই মাসের তুলনায় আগস্টে মূল্যস্ফীতি কমেছে।
মূল্যস্ফীতি ১০ এর নিচে আনতে করণীয় পদক্ষেপ সম্পর্কে তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে তিনটি করণীয় কাজ রয়েছে। ১. সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি। ২. ডলারে জোগান বাড়ানো। ডলারে জোগান বাড়লে পণ্য আমদানিতে প্রভাব পড়বে না। ৩. বাজার ব্যবস্থা উন্নতি করা। বাজারে যে চাঁদাবাজি চলে তা বন্ধ করতে হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যবৃদ্ধির হার কমলেও পণ্যের দাম কমেনি। মূল্যস্ফীতি এখনো দুই অংকের ঘরে রয়েছে। এটাকে ঋণাত্মক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে বাজারে চাঁদাবাজি ও কারসাজি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সেই সঙ্গে নিত্যপণ্যের দাম না কমলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমিয়ে দেখানো বিবিএসের পদ্ধতিগত সমস্যা। ফুড বাস্কেটের পরিবর্তনও মূল্যস্ফীতি কমিয়ে দেখাতে প্রভাব রাখতে পারে। পরিসংখ্যানের এ দুর্বলতাকে সামনে এনে সরকারের এ সংস্থাটিকে সংস্কারের কথাও বলছেন তারা।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা মুজেরী বলেন, ‘পদ্ধতিগত সমস্যার কারণে পরিসংখ্যানে পক্ষপাতিত্ব সৃষ্টি হয়। যেমন- বিভিন্ন পণ্যের দামের ক্ষেত্রে হয়তো নিম্নতম গড় হারটা নিচ্ছি। ফুড বাস্কেটের পরিবর্তনও মূল্যস্ফীতি কমিয়ে রাখতে প্রভাব ফেলতে পারে। এখনো সঠিকভাবে মূল্যস্ফীতি আমরা নিরূপণ করতে পারি না। পরিসংখ্যানের দুর্বলতাগুলো দেখা উচিত। যত দ্রুত এসব দূর করা সম্ভব হবে, ততই সংস্কার প্রক্রিয়ার জন্য মঙ্গল হবে। পরিসংখ্যানও হবে বাস্তবসম্মত। তবে এক মাসের তথ্য দেখেই মূল্যস্ফীতি কমছে এটা বলা যাবে না, আরো দুই-এক মাস দেখতে হবে।’
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত ৩১ আগস্ট বাজারে মোটা চালের কেজি ছিল ৫২-৫৫ টাকা। যদিও মাসের শুরুতে ছিল ৫০-৫৪ টাকা কেজি। একইভাবে মাঝারি ও সরু চালের দামও কেজিতে ২-৩ টাকা বেড়েছিল। গত মাসের শুরুতে ফার্মের মুরগির ডিমের হালি ৪৮-৫২ টাকায় বিক্রি হলেও মাস শেষে ৫০-৫৩ টাকায় ওঠে। একই সময় রুই মাছের দামও ৩০০-৪০০ টাকা থেকে বেড়ে ৩৫০-৪০০ টাকা হয়। দাম বাড়ার পেছনে প্রথমত সরবরাহ সংকট ও বন্যাকে দায়ী করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। যদিও বাজার বিশ্লেষক এবং খুচরা বিক্রেতারা দায়ী করেন চালের আড়তদারদের কারসাজিকে। তবে ওই সময় রাস্তায় চাঁদাবাজি না থাকায় সব ধরনের সবজির দাম কিছুটা কমেছিল।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত আমন মৌসুমে চাল উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৭৪ লাখ টন, যা বিগত যে কোনো বছরের চেয়ে বেশি। এছাড়া গত বোরো মৌসুমেও রেকর্ড চাল উৎপাদন হয়। ২ লাখ ২২ হাজার টন লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও উৎপাদন হয় ২ লাখ ২৪ হাজার টন।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে খাদ্য মজুদের পরিমাণ ছিল ১৯ লাখ ৭০ হাজার ৭৭৯ টন। এর মধ্যে চাল ছিল ১৪ লাখ ৬৪ হাজার ২৩৪ টন। প্রায় এক মাস আগে ৭ আগস্টও চালের মজুদ ছিল ১২ লাখ ৯৭ হাজার ৪৭৪ টন। অর্থাৎ দেড় লাখ টনের বেশি মজুদ বেড়েছে। তবে মজুদ বাড়লেও এ সময়ে খুচরা বাজারে চালের দাম বাড়ছে।
দুই বছর ধরেই দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সর্বশেষ গত জুলাইয়ে দেড় দশকের সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি রেখে ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। তবে শেখ হাসিনা সরকার শেষ সময়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বৃদ্ধিকেই প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু তাতে সফলতা না এসে উল্টো বেড়েছিল। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হিসেবে দেখছে বর্তমান সরকারও। তাই আবারো বাড়ানো হয়েছে সুদহার। সংশ্লিষ্টরা অবশ্য বাজার ব্যবস্থাপনায় বড় কোনো পদক্ষেপ দেখছেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এমএম আকাশ বলেন, ‘স্বল্প সময়ে পণ্যমূল্যের পরিবর্তনে মূল্যস্ফীতির হ্রাস-বৃদ্ধির প্রবণতা বোঝা যায় না। আর চালের দাম যদি বেড়ে থাকে তাহলে পণ্যটির ওয়েট (ভার) কম ধরে মূল্যস্ফীতি হিসাব করেছে কিনা? আর এমনটা হয়ে থাকলে তা হবে চালাকি।’
Leave a Reply