প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নানা আলোচনা-সমালোচনায় উঠে এসেছে ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের (সিএমএসএফ) নাম। পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের অবণ্টিত লভ্যাংশ বণ্টন, বাজারের স্থিতিশীলতা রক্ষায় পরিচালিত এই ফান্ডটির বৈধতা এবং স্বচ্ছতা নিয়ে শুরু থেকেই উঠেছে নানা প্রশ্ন। বিনিয়োগকারীদের টাকায় বিলাসবহুল অফিস, চেয়ারম্যান-এমডির জন্য দামি গাড়ি আর পাঁচ তারকা হোটেলে লাখ টাকা খরচ করে করা বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান নিয়ে বার বার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এই সিএমএসএফ।
অভিযোগ আছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক সময়ের মূখ্য সচিব নজিবুর রহমানসহ কিছু ব্যক্তিকে পুনর্বাসিত করা করা ছিল সিএমএসএফ গঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান তার ঘনিষ্ট ব্যক্তিদের নানা সুবিধা দিয়ে একটি শক্তিশালী বলয় তৈরি করার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সিএমএসএফ ছিল তার ওই পরিকল্পনার একটি অংশ। সিএমএসএফ বিনিয়োগকারীদের প্রাপ্য লভ্যাংশ ফিরিয়ে দেওয়ার কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার চেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকীসহ নানা দিবস পালনে ছিল বিশেষ মনোযোগী।
বিনিয়োগকারীদের প্রাপ্য লভ্যাংশের টাকায় সংস্থাটির সাবেক চেয়ারম্যানের জন্য কেনা হয়েছে কোটি টাকার গাড়ি। অপ্রয়োজনীয় নানা কমিটি গঠন করে সভায় অংশগ্রহণের সম্মানি হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা।
যদিও প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কোম্পানি থেকে সংগৃহীত অবণ্টিত লভ্যাংশের টাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রেখে তার থেকে পাওয়া সুদের টাকা দিয়ে অফিস, একটি মিতসুবিশি পাজেরো স্পোর্টস ও একটি টয়োটা করোলা ক্রস গাড়ি এবং পাঁচ তারকা হোটেলের খরচ মেটানো হয়েছে। কিন্তু বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই সুদের টাকার দাবিদারও বিনিয়োগকারীরা। তারা মনে করেন বিনিয়োগকারীদের সম্পদ ব্যাংক কিংবা কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রেখে অন্যকোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সেই টাকার ইন্টারেস্ট ভোগ করার কোন সুযোগ নেই।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, সিএমএসএফের গঠন পদ্ধতিটিই আপত্তিকর। সিএমএসএফের সৃষ্টি, গঠনতন্ত্র এবং পরিচালনা নিয়ে আমাদের আপত্তিকর। সিএমএসএফ নিয়ে একটি বড় অডিট বা নিরীক্ষার দাবি জানাচ্ছি। সংগৃহীত ফান্ডগুলি কিভাবে এবং কোথায় কোথায় ব্যবহার করা হয়েছে তা তদন্ত করে দেখতে হবে। সিএমএসএফের একটি গঠণযোগ্য, পুঙ্খানুপুঙ্খ নিরীক্ষা করা হোক এবং ভবিষ্যতে সিএমএসএফ কিভাবে পরিচালিত হবে এবং আদও এর প্রয়োজন আছে কিনা তা খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি।
এছাড়াও, পুঁজিবাজারের সংকটে স্থিতিশীলতা আনতে সহায়তার জন্য গঠন করা হয় মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড (সিএমএসএফ)। তবে এ ফান্ডের সুফল তো আসেইনি পুঁজিবাজারে উল্টো তিন বছরে শুধু বৈঠক করেই ৩ কোটি টাকার বেশি পকেটে পুরেছেন এই ফান্ডের পর্ষদ ও বিভিন্ন কমিটির দায়িত্বে থাকা বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ ও সুবিধাভোগীরা।
পুঁজিবাজার স্থিতিশীল করার মতো কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেনি সিএমএসএফ। বরং, এর পর্ষদ এবং কমিটির অন্য প্রায় এক ডজন সদস্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের চেয়ে সভা করতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন। এর বিপরীতে মোটা অঙ্কের সম্মানী নিতেন তাঁরা।
জানা গেছে, গত তিন বছরে ৩২৩টি বৈঠক করেছে সিএমএসএফের বিভিন্ন কমিটি। অর্থাৎ, প্রতি বছর ১০০ টির বেশি বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে অংশ নেওয়া প্রত্যেক সদস্যের সম্মানী ছিল ৮ হাজার টাকা। তিন বছরে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে তেমন কোনো পদক্ষেপ না নিলেও কেবল বৈঠক করেই তাঁরা সম্মানী হিসেবে পকেটে পুরেছেন ৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
সিএমএসএফের লক্ষ্য ও আকার যত বড়, সেই তুলনায় ফলাফল কিছুই আসেনি। চলতি বছরের ৩০ জুলাই পর্যন্ত সিএমএসএফের তহবিল দাঁড়ায় ১ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা। এ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) ২২৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। আইসিবি সেই টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু এই সামান্য বিনিয়োগ বাজারের সার্বিক স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখতে পারেনি।
এ ছাড়া ৫০ কোটি টাকা দিয়ে একটি মেয়াদী মিউচুয়াল ফান্ড চালু করা হয়েছে। বিশাল ব্যয়ে এই ফান্ডের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় রাজধানীর এক পাঁচ তারকা হোটেলে।
এর বাইরে বাজার স্থিতিশীলতায় সিএমএসএফের কোনো ভূমিকা নেই।
সিএমএসএফের সদ্যবিদায়ী চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান যিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব ছিলেন, তাকে নিয়েও বাজার সংশ্লিষ্টদের মাঝে রয়েছে নানা সমালোচনা। মুখ্য সচিব থেকে অবসরে যাওয়ার পর তাকে ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের (সিএমএসএফ) চেয়ারম্যান বানানো হয়। পুঁজিবাজারের ব্যাপারে ন্যূনতম অভিজ্ঞতা না থাকলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন, এই পরিচয়ে তাকে দেওয়া হয় এই পদ। পুঁজিবাজার থেকে এসব সুবিধা নেওয়ার ব্যাপারে তাকে সহায়তা করেছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সদ্যবিদায়ী চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম।
এদিকে, সিএমএসএফের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে তৎপর হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ফান্ডের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে রূপরেখা প্রণয়নের জন্য ৬ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের ট্রেজারি ও ঋণ ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করা হয়। এতে সই করেছেন সিনিয়র সহকারী সচিব কাজী লুতফুল হাসান।
কমিটির কাজ হবে— সিএমএসএফের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে করণীয় নির্ধারণ, তহবিল ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সুপারিশ প্রণয়ন এবং অন্যান্য কার্যক্রম নির্ধারণ করে দেওয়া।
মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়েছে, কমিটির আহ্বায়ক থাকবেন অর্থ বিভাগের ট্রেজারি ও ঋণ ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপযুক্ত প্রতিনিধি সদস্যসচিব হিসেবে কাজ করবেন।
এ ছাড়া কমিটির সদস্য হিসেবে থাকবেন অর্থ বিভাগের ঋণ ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপযুক্ত প্রতিনিধি, যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধক বা আরজেএসসির উপযুক্ত প্রতিনিধি, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের উপযুক্ত প্রতিনিধি।
নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের (সিএমএসএফ) সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে ৬ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে কমিটিকে আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
Leave a Reply