শ্বাসকষ্টের সমস্যা নানা রোগের উপসর্গ। এটি কোন রোগ নয়। ঘন ঘন শ্বাস ওঠানামা, দম বন্ধ অনুভূতি এসব হলে আমরা বলি শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তবে শ্বাসকষ্ট নিজে কোনো রোগ নয়। শ্বাসকষ্ট হলে প্রথমেই মাথায় আসে হৃদরোগ আর ফুসফুসের নানা জটিলতার কথা। কারণ এসব রোগকে আমরা ভয় পাই। এছাড়া ঠান্ডা কাশি হলেও শ্বাসের সমস্যা হতে পারে।
দূষিত বায়ুতে শ্বাস নিতে নিতে আমাদের শরীরের বারোটা বেজে যায়। বিশেষ করে, অ্যাজমা -এর মতো জটিল অসুখে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। আর এইসব রোগের প্রথম পর্যায়ে হঠাৎ করেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। এই রোগের প্রথম পর্যায়ে চিকিৎসা নিলে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বাড়ে। তাই সমস্যা হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তাছাড়া হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া সম্ভব না হলে বাড়িতে কিছু নিয়ম মানতে হবে। তাহলে কিছুটা হলেও এর থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
বাড়িতে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট হলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সময় থাকে না। তখন নিজেই কিছু কৌশল অনুসরণ করা যেতে পারে |
হঠাৎ শ্বাসকষ্ট হলে যেসকল কৌশল অনুসরণ করা যেতে পারে
১. হঠাৎ শ্বাসকষ্ট হলে বালিশ দিয়ে মাথার দিকটা উঁচু করে কাত হয়ে শুয়ে থাকতে হবে। তখন হাঁটু সামান্য ভাঁজ করা যেতে পারে।
২. চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর বালিশ রেখে তাতে মাথা নিচু করে শুলে ভালো বোধ করবেন।
৩. আবার একটা চেয়ারকে সাপোর্ট হিসেবে ব্যবহার করে ঝুঁকে থাকলেও এ সমস্যা কিছুটা হলেও কমে।
৪. দেয়াল থেকে এক ফুট দূরত্বে পা রেখে দেয়ালে শরীর হেলান দিয়ে দাঁড়ালে শ্বাসকষ্ট অনেকটা কমে যায়।
যাদের হাঁপানি আছে তারা মাঝরাতে কিংবা ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসে থাকে এবং সে সময় তাদের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। এসব রোগীর আশপাশে যারা থাকেন তারা শুনতে পান রোগীর বুকের ভিতর শোঁ- শোঁ শব্দ হচ্ছে। তখন এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মনে হয় যে, তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ভোরের দিকে বেশি শুরু হয়। দেখা যায়, প্রথমদিকে হালকা শ্বাসকষ্ট এবং তা বেশিরভাগ সময় ক্ষণস্থায়ী হয়। এক্ষেত্রে কতগুলো লক্ষণ দেখা যায়, যথা- ক্রমাগত হাঁচি, নাক বা চোখ দিয়ে পানি পড়া, নাক-চোখ-মুখ চুলকানো ইত্যাদি। বিশেষ করে ঋতু পরিবর্তনে এগুলো বেশি চোখে পড়ে।
তবে অনেকেরই একাধারে শ্বাসকষ্টের সমস্যা থাকে না। বরং তারা ক্ষেত্র বিশেষে এই সমস্যায় আক্রান্ত হন। যেমন সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় বা হাঁটাচলা করার সময় তাদের হঠাৎ করেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। এই সময় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেই সমস্যা প্রশমিত হয়ে যেতে সময় লাগে না।
শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা
আমাদের দেশে বেশিরভাগ মানুষের ধারণা ইনহেলার হলো হাঁপানি রোগের শেষ চিকিৎসা। আমাদের অনেকের ধারণা ইনহেলার একবার ব্যবহার করলে ভবিষ্যতে আর কোন ওষুধ কাজ করবে না। ডাক্তারী ভাষায় ইনহেলার হলো এই রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা। এ ওষুধ সঠিকভাবে নিতে পারলে শ্বাসকষ্ট কমতে সময় লাগে ১৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা। সঠিক পদ্ধতিতে ইনহেলার ব্যবহারের পরও যদি রোগীর শ্বাসকষ্ট না কমে তবে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
যেসব রোগ থাকলে শ্বাসকষ্ট হয়
সাধারণভাবে, সর্দি-কাশি হলে শ্বাসকষ্ট হয়। অনেকের সাইনোসাইটিস হলেও শ্বাসকষ্টের প্রকোপ বাড়ে। সাইনোসাইটিসের ক্ষেত্রে ঠিক ফুসফুস শ্বাসকষ্টের জন্য দায়ী নয়। এ ক্ষেত্রে নাকের ভেতরের গাত্র প্রদাহে আক্রান্ত হয়ে ফুলে যায়, তাই প্রয়োজনীয় বাতাস নাক দিয়ে ফুসফুসে ঢুকতে পারে না।
১. ফুসফুসে পানি জমে গেলে শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দেয়।
২. হৃৎপিণ্ডের বাম পাশের কার্যকারিত কমে গেলেও ভয়াবহ পারে শ্বাসকষ্ট।
৩. অ্যাজমা বা হাঁপানি থাকলে, ব্রঙ্কাইটিসের কারণে ফুসফুসের ব্রঙ্কিউলের কিছু কিছু অংশ বন্ধ হয়ে গেলে হতে পারে।
৪. আবার কোনো কারণে ফুসফুসের ভেতরের ছোট ছোট রক্তনালির অভ্যন্তরের রক্ত জমাট বেঁধে গেলে হতে পারে।
৫. ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা যেমন ডায়াবেটিস কিটোএসিডোসিস হলে, রক্তে এসিডের মাত্রা বেড়ে গেলেও আপনি শ্বাসকষ্টে ভুগতে পারেন।
তবে, জ্বরের মতো শ্বাসকষ্ট নিজে কোনো রোগ নয়। এটি অন্যান্য রোগের লক্ষণ হিসেবে দেখা দেয়। সাধারণত নাক বন্ধভাব, সর্দি, চোখে চুলকানি ও পানি ঝরা, বুকে চাপ চাপ বোধ, কাশি, হাঁচি, দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস ইত্যাদি উপসর্গ শ্বাসকষ্টের সঙ্গে থাকে।
শ্বাসকষ্টের ধরণ
শ্বাসকষ্ট সাধারণত দুই ধরনের। প্রথমটি হলো অ্যাকিউট বা তীব্র ধরনের, যা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তীব্র শ্বাসকষ্টে পরিণত হয়। এতে অতি দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। দ্বিতীয়টি ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্ট, যার তীব্রতা প্রথমে কম থাকে, পরে বাড়তে থাক
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতকালে শ্বাসকষ্ট বাড়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ প্রাকৃতিক নানা কারণ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। যাদের শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে তারা শীতকালে একটু সাবধান-ই থাকেন।
• শীতকালে বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ অনেকটা কমে যায়। বাড়ে ধুলার পরিমাণ। সেগুলিই ফুসফুসে ঢুকে শ্বাসের সমস্যা বাড়ায়।
• বাতাসে ফুলের রেণুও এই সময় প্রচুর পরিমাণে ওড়ে। ফুসফুসে ঢুকে সেগুলিও অ্যালার্জির সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। শ্বাসকষ্ট বাড়ে।
• শীতকালে বায়ুদূষণের পরিমাণও অনেক বেড়ে যায়। এটি শ্বাসকষ্টের সবচেয়ে বড় কারণ।
শীতে শ্বাসকষ্ট কমাতে দেখে নিন এই উপায়গুলো:
১. বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।
২. ঘরের ভিতর সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে।
৩. শীতকালে অবশ্যই ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। যাদের শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে, তারা যদি শীতে ধূমপান করেন, তাদের ফুসফুসের উপর চাপ পড়ে।
৪. আদা খেতে পারেন, এটা শ্বাসনালীর প্রদাহ কমিয়ে অক্সিজেনের প্রবেশ স্বাভাবিক রাখে। আদা চা বা আদার রস ও মধু মিশিয়ে খান
৫. সরিষার তেল হালকা গরম করে বুকে-পিঠে, গলায় ভালো করে ম্যাসাজ করুন শ্বাসকষ্ট কমে যাবে।
হঠাৎ শ্বাসকষ্ট হলে ব্যায়াম নিয়ে বিবিসি জানিয়েছে- কিছু ব্যায়ামের কথা। এগুলো বেশ কাজে দেবে তেমনটাই জানয়েছেন বিশেষজ্ঞরা-ও।
হঠাৎ শ্বাসকষ্ট হলে যেসকল ব্যায়াম ভালো কাজ দেয়
১. সোজা হয়ে বসুন, আপনার হাত দুটি থাইয়ের ওপর রাখুন।
২. মুখ খুলে যতটা সম্ভব বাতাস টেনে নিন।
৩. ঠোঁট চেপে রাখুন।
৪. যতক্ষণ সম্ভব ততক্ষণ শ্বাসটা শরীরের মধ্যে রেখে দিন। আপনি কতক্ষণ ধরে এটি আটকে রাখতে পারেন তার ওপর আপনার ফুসফুসের সুস্বাস্থ্যের দিকটি নিশ্চিত হয়।
৫. বুক ভরে শ্বাস নিয়ে যতক্ষণ সম্ভব ধরে রাখা- এরপরে আস্তে আস্তে শ্বাস ছাড়তে হবে। এরফলে ফুসফুসের কোষগুলোর ব্যায়াম হয়, ফলে সেটির স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে না।
শ্বাসকষ্টের ক্ষেত্রে অ্যালার্জি একটি বড় কারণ। এটি শ্বাসকষ্টকে বাড়িয়ে তোলে। এখানে রোগীরও কিছু কিছু জিনিস জেনে রাখতে হবে, কিছু খাবার থেকে আবার কোনো রাসায়নিক জাতীয় জিনিস বা ধুলাবালি থেকে, আবহাওয়ার যে পরিবর্তন হয়, সে ক্ষেত্রেও কিন্তু অনেক সময় এটা হতে পারে। শ্বাসকষ্ট বায়ু দূষণে বেড়ে যায়। শরীরচর্চা বিহীন জীবনযাপনেরও প্রভাব রয়েছে অবশ্য। অনেকের মধ্যে বংশগত কারণেও এই সমস্যা এসে হাজির হয়।
Leave a Reply