‘আ ওয়েল স্পেন্ট ডে ইন টরন্টো’, সাকিবের আত্মম্ভরিতার কফিনে শেষ পেরেক!

২০১৪ সাল। ওই বছর উইম্বলডনে রাশিয়ান টেনিস সুন্দরী মারিয়া শারাপোভার খেলা দেখতে গিয়েছিলেন ভারতের ক্রিকেট কিংবদন্তি শচীন টেণ্ডুলকার। সঙ্গে গ্যালারিতে ইংল্যান্ডের সাবেক ফুটবল অধিনায়ক ডেভিড বেকহাম এবং দেশটির সাবেক ক্রিকেট অধিনায়ক অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস।

খেলা শেষে শারাপোভাকে বলা হয়, গ্যালারিতে বেকহাম রয়েছেন। তার ম্যাচ দেখেছেন। শারাপোভা এটি শুনে বলেছিলেন, বেকহাম দারুণ মানুষ। আমাদের কয়েকবার দেখাও হয়েছে। পরে তাকে জানানো হয়, গ্যালারিতে শচীন টেণ্ডুলকারও আছেন। জিজ্ঞেস করা হয়, শচীনকে চেনেন? শারাপোভা বলেন ‘না’।

এরপর ভারতজুড়ে এই টেনিস তারকার তুমুল সমালোচনা হয়। শারাপোভাকে একরকম মাটিতে নামিয়ে সামাজিকমাধ্যমে ভক্তরা ট্রল আর মিমে মেতে উঠেন। ফেসবুক-টুইটারে ‘হু ইজ শারাপোভা’ ভারতজুড়ে তখন ট্রেন্ডিংয়ে। মুহুর্তে ভারতীয় ফলোয়ার কমতে থাকে টেনিস তারকার।

এক শচীনভক্ত তো বলেই দিয়েছিলেন, শারাপোভা হয়তো ‘নাস্তিক’। তাই তিনি ‘ঈশ্বর’ শচীনকে চেনেন না। শুধু তাই নয়, শারাপোভা যে সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করছিলেন, সেসব জায়গায় একচেটিয়া নেতিবাচক মন্তব্য করা হয়।

তখন শচীনকে না চেনায় ভারতীয়রা একজোট হয়ে শারাপোভাকে একহাত নিয়েছিলেন। কিন্তু ২০২১ সালে সময়ের পরিক্রমায়, তারাই আবার শচীন প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে পড়েন। ওই সময় ভারতের রাজধানী দিল্লি কৃষক আন্দোলনে উত্তাল। সামাজিকমাধ্যমে কৃষক আন্দোলনের সমর্থকেরা আশা করেছিলেন দেশের তারকারা তাদের পক্ষে দাঁড়াবেন। কিন্তু না, প্রায় মাসব্যাপী আন্দোলনের পরও ‘ক্রিকেট দেবতা’ শচীন নিশ্চুপ।

অথচ ভারতের কৃষক আন্দোলনের তীব্র আকাঙক্ষা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন পপ তারকা রিয়ানা, পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ। শচীন যখন মন্তব্য করলেন তখন মোটাদাগে বলা যায়, সেটি ছিল শাসকগোষ্ঠী বিজেপির পক্ষ হয়ে জবাব দেওয়া। শচীন বিজেপির সঙ্গে সুর মিলিয়ে স্বাধীনতার জন্য ব্যাট ধরলেন। কিন্তু তার টুইটে ‘কৃষক’ শব্দটিও ছিল না। তাদের জন্য ছিল না কোনো সহমর্মী বার্তা।

ওই সময় ভারতের বেশিরভাগ গণমাধ্যম শাসকগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকায়, কৃষক আন্দোলনকারীরা চেয়েছিল তাদের হয়ে কেউ কথা বলুক। স্বদেশী তারকা ও বহির্বিশ্বের কেউ কথা বললে, সরকারের ওপর চাপ বাড়বে। যখন রিয়ানা ভারতের কৃষক আন্দোলন নিয়ে পুরো বিশ্বকে নজর দিতে বললেন, ঠিক তখনই দেশের বদনাম ঠেকাতে টুইট করলেন শচীন। এরপর নেটিজেনরা বলাবলি করছিলেন, সত্যিই চেনার মতো কোনো গুণ শচীনের নেই। এমন শচীনকে নাকি তারাও চেনেন না।

শচীনকে নিয়ে মহাকাব্য কিংবা বীরত্বগাঁথার হাজারো রচনা লেখা হতে পারে, কিন্তু কৃষক আন্দোলনে ‘সরকারি পক্ষ’ হয়ে যে টুইট তিনি করেছিলেন, ওই সময়ের পদক্ষেপ শচীনকে পড়ার এবং জানার ভিন্ন জানালা খুলে দেয়। ‘ইন্ডিয়া এগেইনস্ট প্রোপাগান্ডা’, ওই সময়ে কাদের হ্যাশট্যাগ ছিল, তা আজ ব্যাখ্যা করা বাতুলতা।

সামাজিকমাধ্যম এমন এক যন্ত্র, যেখানে জনআকাঙক্ষা ধরতে না পারলে অনেক সময় কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হয় তারকাদের। দক্ষিণ এশিয়ার মতো দেশগুলোর জন্য সেটা আরো কঠিন।

গত জুলাইয়ে বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন যখন রক্তক্ষয়ী সংঘাতে রুপ নেয়, ঠিক তখন সাকিব আল হাসানের স্ত্রী উম্মে শিশির ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে লিখলেন, ‘আ ওয়েল স্পেন্ট ডে ইন টরন্টো’। বছরের পর বছর সাকিব একাধিক বিতর্কে জড়িয়েছেন, সাবলীলভাবে এ সব বিতর্কও পাশ কাটিয়ে গেছেন। কিন্তু এবার সম্মুখপানে এতো বড় প্রাচীর, সাকিব না পারলেন টপকাতে, না পারলেন এড়িয়ে যেতে।

ঢাকার সংবাদমাধ্যমগুলোর কাছে সাকিব ‘বিরল মস্তিস্ক’। তিনি সব বিতর্ক একপাশ রেখে মাঠের ক্রিকেটে দুর্দান্ত। ক্রিকেটার সাকিব বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তারকা, বিতর্ক ছাড়াই দেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার। তার কঠোর সমালোচকরাও স্বীকার করবে নির্দ্বিধায়। এটি বাড়িয়ে বলা কিংবা অত্যুক্তিও নয়।

বিশ্ব ক্রিকেটে সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা বাংলাদেশ থেকে নির্দিষ্ট একজন ক্রিকেটার থাকলে, সেটি নির্মোহভাবে সাকিব। তার ব্যাটে-বলে বাংলাদেশ যেভাবে মূর্ত হয়েছে, বিশ্ব ক্রিকেটে আর কোনো বাংলাদেশি তার ধারেকাছেও নেই। কিন্তু ক্যারিয়ারের শেষপ্রান্তে থাকা এই সাকিবকে নিয়ে বিভক্ত হয়ে গেল সমর্থককূল। দেশের গণতন্ত্রপন্থিদের কাছে সাকিব বিদ্ধ হলেন ‘স্বৈরতন্ত্রের সহযোগী’ হিসেবে।

মুহুর্মুহু গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড কিংবা টিয়ারশেলের মুখে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুরো রাজধানী ঢাকা যখন বিক্ষোভে উত্তাল, তখন সাকিবের সহধর্মিনী ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে তারকা স্বামীর হাসোজ্জ্বল ছবি শেয়ার করলেন। আর একটি ছবিই সাকিবকে টেনে নিয়ে গেলো পার্সি শেলীর ওজিম্যানডিয়াসের কবিতার সেই কঠিন পরিণতির দিকে। কিংবা রবার্ট ব্রাউনিংয়ে দ্য প্যাট্রিয়ট হয়ে। ভক্তদের অনেকে সাকিবকে ‘সাকিং’ মানে রাজার সঙ্গে তুলনা করতেন। আর একসময়ের প্রশংসিত সেই ব্যক্তি এখন নির্দয়ভাবে অভিযুক্ত।

২০১৮ সালে নিদাহাস ট্রফিতে সাকিবের প্রতিবাদী আচরণের কথা কে না জানে! আম্পায়ার ‘নো বল’ দিতে রাজি না হওয়ায়, বাউন্ডারির কাছে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন সাকিব। সে ভিডিও ক্লিপ ওইরাতে একবার বারবার কতশতবার দেখেছেন ভক্তরা।

২০১৯ সালে জুয়াড়ির সঙ্গে ‘গোপন’ যোগাযোগের তিনটি অভিযোগে সাকিবকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল আইসিসি। ওই ঘটনা সাকিব স্বীকার করে শাস্তি মেনে নেন। কিন্তু সমর্থকরা মনে করেছিল, এটি বিসিবি কিংবা নাজমুল হাসান পাপনের ‘ষড়যন্ত্র’।

কারণ এই শাস্তির কিছুদিন আগেই ক্রিকেটারদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সাকিব। তখন সেটি ভালোভাবে নেয়নি বিসিবি। এটি প্রমাণিত, সাকিব জুয়াড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। নীতিবিরুদ্ধ কাজ করার পরও সমর্থকদের সিংহভাগ সাকিবের পক্ষেই ছিল।

ঢাকার ঘরোয়া ক্রিকেট ডিপিএলে আম্পায়ারের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে সাকিব মাঠেই স্ট্যাম্পে লাথি মেরে প্রতিবাদ করেছিলেন। তখন সাকিবের এমন মানসিকতার প্রশংসা করেছিল দেশের বেশিরভাগ মানুষ। কারণ দীর্ঘদিন ধরে দুর্বল মানের আম্পায়ারিং নিয়ে এমন নজিরবিহীন প্রতিবাদ আগে কেউ করেনি।

২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে শ্রীলংকার বিপক্ষে ম্যাচে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসকে টাইমড আউটের আবেদন করেছিলেন অধিনায়ক সাকিব। বিশ্ব ক্রিকেটে অনেকে সাকিবের ‘ক্রিকেটীয় চেতনা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। সামাজিকমাধ্যমে লংকান সমর্থকদের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে চলছিল টাইগার সমর্থকদের। আর ওই সময়ও সাকিবের পক্ষ হয়ে লড়েছিলেন সবাই।

অবশ্য ২০২২ সালে বেটিং সাইটের সঙ্গে চুক্তি, এ ছাড়া ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলতে ভারতে যাওয়ার প্রাক্কালে একটি বেসরকারী টেলিভিশনকে সাক্ষাৎকার দিয়ে নিন্দার মুখে পড়েছিলেন সাকিব।

এখানে আরো একটি প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দেওয়ার। আইপিএল খেলতে সাকিব যতবার সুযােগ পেয়েছেন, বিসিবির ‘এনওসি’ ইস্যুতে বরাবরই সাকিবের পক্ষে  সামাজিকমাধ্যমে সরব ছিল সমর্থকেরা। আইপিএলে সাকিবের চেয়েও অনেক বড় তারকারা খেলেন। কিন্তু বাংলাদেশের মতো সমর্থক খুব কম দেশে আছে, যারা বড়মঞ্চে তাদের প্রিয় ক্রিকেটারের খেলা দেখার জন্য এতো উদগ্রীব থাকেন। সাকিব এমন সমর্থন বহু বছর পেয়ে এসেছেন।

অথচ এবার কানাডার লিগ চলাকালে সাকিব এক ভক্তের সঙ্গে এই প্রতিদান দিলেন উল্টো। ছাত্র আন্দােলনে কেন চুপ তা জানতে চাওয়ায়, সাকিব পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন ‘দেশের জন্য আপনি কী করেছেন?’। আর সরকার পতনের পর একই লিগে সাকিবকে শুনতে হয় ‘দালাল’। সমর্থকদের একসময়ের গভীর অনুরাগ ঠিক কোথায় গিয়ে ঠেকেছে ভাবা যায়!

দলমত নির্বিশেষে যারা সাকিবকে আইকনে রূপান্তর করেছিলেন, গোটা দেশ যখন নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চিত, ঠিক তখনই নির্দিষ্ট দলের হয়ে ভোটে নেমে সমর্থকদের মধ্যে ‘বিভেদের রেখা’ এঁকে দিলেন সাকিব। তোড়জোড় করে মনোনয়ন নিশ্চিতে সাকিবের দৌড়ঝাপ ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেকে সাকিবের রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পেছনে ব্যবসায়িক উচ্চভিলাসও দেখেন। মাঠের ক্রিকেটে লড়াই করে বহু ম্যাচ জিতিয়েছেন সাকিব। কিন্তু ভোটের মাঠে জয় পেয়ে গেলেন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই। আর ‘কাঙিক্ষত স্বপ্ন পূরনের’ ৭ মাস না যেতেই রাজনৈতিক জীবনের অকল্পনীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেন ৩৭ বছর বয়সি এই ক্রিকেটার।

সাকিব সস্ত্রীক মার্কিন মুলুকে থাকেন বছরের পর বছর। তার সব সন্তানদের জন্ম সেখানে। দেশে এর আগে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে দুটি নির্বাচন নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক হয়নি। মানুষ তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। এ হাহাকার দেশের তরুণদের তাড়া করে বেড়িয়েছে দিনের পর দিন। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সংকুচিত হয়ে ‘একক দল’ নির্ভর হয়ে উঠে।

সাকিব যখন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে নামলেন। ফরাসি বার্তাসংস্থা এএফপি তাদের প্রতিবেদনে লিখেছিল, দক্ষিণ এশিয়ার ক্রিকেটারদের জন্য রাজনীতিতে আসা নতুন কিছু নয়, তবে বর্তমান ক্রিকেটার হিসেবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ‘অবশ্যই বিরল’।

ওই প্রতিবেদনের বয়ান ছিল এরকম— সাকিব এমন দলে যোগ দিচ্ছেন, যে দলটির নেতা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ‘লোহার মুষ্টি দিয়ে’ দেশ শাসনের অভিযোগ রয়েছে।  এছাড়া আসন্ন নির্বাচনে বিরোধীরা অংশ না নিলে চতুর্থবারের মতো তার ক্ষমতায় যাওয়া প্রায় নিশ্চিত। হাসিনার অধীনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উন্নতি হলেও, সারা দুনিয়ার কাছে গণতন্ত্র অবনমন এবং গত দুটি নির্বাচনে ভোট কারচুপিতে কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ।


৪ 

সাকিব নিজে জানতেন, দ্বাদশ সংসদের এই ভোটের লড়াই হবে একপাক্ষিক। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিশ্চিত হলেই তিনি সংসদ সদস্য। অথচ ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিক হওয়া পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের গল্পটা পুরো ভিন্ন। ইমরানের রাজনৈতিক দৃঢ়তা, নিবেদন এবং চিন্তা অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট।

এখন ইমরান লড়াই করে যাচ্ছেন দেশটির ক্ষমতাধর সেনাবাহিনীর সঙ্গে। কার্যালয়ে পুলিশি তল্লাশি, গণগ্রেফতার, একের পর মামলার মুখে পড়েও নতি স্বীকারের পক্ষপাতি নয় ইমরান। বরং জেলে থেকেও ব্যক্তিগত ক্যারিশমা, জনমোহিনী বক্তৃতা এবং রাজনৈতিকভাবে নতি স্বীকার না করার মানসিকতার কারণে ইমরানকে আরো জনপ্রিয় করে তুলেছে।

ইমরান পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ জিতিয়েও মনে করেছেন, রাজনীতিতে সফল হওয়া ‘শর্টকার্ট’ বিষয় নয়। পরিশ্রম করেছেন, মানুষের দোরগোড়ায় গিয়েছেন, তরুণদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, সরকারপ্রধান হয়েছেন আবার ক্ষমতাচ্যুত হয়ে কারাজীবনকেও বেছে নিয়েছেন।

কিন্তু সাকিব ভাবলেন, তার বহুল তারকাখ্যাতি। ইমরানের মতো পরিশ্রম তার কাছে ‘ঐচ্ছিক’। মনোনয়ন পেয়ে সাকিব যখন মাগুরায় গিয়েছিলেন, তখন সংবর্ধনা আয়োজন করেছিল তার দল এবং অনুসারীরা। সংবাদমাধ্যমকে সাকিব বলেছিলেন, ১৭ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে অনেক সংবর্ধনা তিনি পেয়েছেন। তবে এবারের সংবর্ধনা তার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন।

রাজনীতিতে অংশগ্রহণের পরও বলা যায়, সাকিবের জনপ্রিয়তায় অতো ধস নামেনি তখনো। ইংরেজিতে যেমন প্রচলিত রয়েছে, আ রোজ ইজ আ রোজ! মানে গোলাপকে যে নামেই ডাকা হোক না, সে গোলাপই থাকে।

সাকিব হত্যা মামলার আসামী, এটা অন্তঃসারশূন্য অভিযোগ। এটা মানুষ বিশ্বাসও করে না। কিন্তু রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে সাকিবপত্নির ‘আ ওয়েল স্পেন্ট ডে ইন টরন্টো’  ইনস্টাগ্রাম স্টোরি সবচেয়ে ‘বিগ ব্লাে’ । সামাজিকমাধ্যমে ওই ছবি তীব্র আঘাত করে জনমানসে। ক্রমবর্ধমান অস্থির রাজনৈতিক সময়ে সামাজিকমাধ্যমের ভূমিকা বুঝতে এটি ‘সিম্বল’ হয়ে থাকবে।

ওই ছবিটি এও বার্তা দেয়, হঠাৎ রাজনীতিক হয়ে উঠা ব্যক্তি যতই ‘মহান’ হোক, তাদের সাধারণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকে না। তারা সাধারণের অনুভূতি স্পর্শ করতে পারেন না। রাজনীতির বাইশ গজ ক্রিকেট থেকে পুরোপুরি আলাদা জগৎ। সাকিবকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন করতে হয়নি। তিনি সময়ের সেরা সুযোগটিই নিতে চেয়েছেন এবং নিশ্চিত করেছেন।

এ ছাড়া জীবনসঙ্গী হিসেবে রাজনৈতিক নেতাদের লড়াই দেখেন তাদের স্ত্রীরা। সাকিবের স্ত্রীকেও এসবের মধ্য দিয়ে যেতে হয়নি। কোনো উৎকণ্ঠা ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রে বসে তিনি জেনে গেলেন তার স্বামী সংসদ সদস্য। কারণ সবার কাছে পরিষ্কার, সরকারি দলের হয়ে নির্বাচনে দাঁড়ালে জয় সুনিশ্চিত।

ক্রিকেটার সাকিবের স্ত্রী আর সংসদের আইন প্রণেতার স্ত্রীর পরিচয় এক নয়। এই ট্রানজিশন বা সময়ের যে পরিবর্তন, সেটা অনুধাবনও করতে পারেননি উম্মে শিশির। সামাজিকমাধ্যমে শিশিরের দায় কী, রিপ্রেজেন্টশন কেমন হওয়া উচিত; এ সম্পর্কে কোনো ভাবনা তাই কাজ করেনি।

দেশের ইতিহাসে আধুনিককালের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। রাজনৈতিক দলের চিরাচরিত আন্দোলন থেকে এটি ছিল পুরোপুরি ভিন্ন পরিবেশ। সাকিব সরকারদলীয় সংসদ সদস্য হিসেবে আন্দোলনে সংহতি না জানাতেই পারেন। স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতেই পারেন। এটা নিয়ে সমালোচনা অমূলক। কিন্তু ওই ঝুঁকিপূর্ণ বিক্ষুদ্ধ সময়ে সামাজিক মাধ্যমে খোশমেজাজের ছবি প্রকাশ, চূড়ান্ত ক্ষোভের জন্ম দেয়। এই কাণ্ড খেলোয়াড়ি জীবন, রাজনৈতিক জীবন সবকিছুকে ছাড়িয়ে সাকিবকে পতিত করেছে নিষ্ঠুর নিয়তির ঘূর্ণিপাকে।


দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সাকিবকে নিয়েই দল ঘোষণা হয়েছিল মিরপুর টেস্টের। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা সাকিবকে ফেরত যেতে হল দুবাই থেকে। দেশে ফেরার খবরে বিসিবির প্রাঙ্গণে সাকিবের বিরুদ্ধে স্লোগান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে কুশপুত্তলিকা দাহ এ সব ঘটনা হঠাৎ করে সৃষ্টি নয়। তবে নিরাপত্তা প্রশ্নে সাকিবকে দেশের মাটিতে অবসর নিতে একরকম বাঁধা তৈরি করা, এটি অন্তবর্তীকালীন সরকার এবং বিসিবির ওপর ‘কালো দাগ’ ফেলবে ভবিষ্যতে।

রাজনৈতিক বিতর্ক ভুলে অগণিত সমর্থকও চান, সাকিব দেশের মাটিতে ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলুক। অনেকে সাকিবের জন্য রাজপথেও নেমেছে। ইতিহাসকে কেউ হেয়ালি করতে পারে, কিন্তু ইতিহাস ক্ষয়হীন। বিসিবি পেশাদার স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে কানপুর টেস্টে সাকিবকে জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল,  ‘হয় এখানে অবসর নাও। না হয় সুবিধামতো সময়ে আরো পরে ভাবো’।

চিরচেনা মিরপুরে সাকিব ক্রিকেট খেলবেন, অবসর নেবেন, এখানে বাধ সাধার কে? সাকিব দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলতে দল মতের ঊর্ধ্বে সবার সমর্থন চাইলেন। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে এমন অনুরোধ করার ‘লোক’ নন সাকিব। সাকিব নিজে যা চেয়েছেন তাই করেছেন গোটা ক্যারিয়ারে। কিন্তু শেষ প্রান্তে এসে নিয়তিই তাকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে।

প্রাচীনকালে গ্রীকরা বিশ্বাস করত, নিয়তির হাত থেকে নিষ্কৃতি নেই। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে সাকিব সেরাদের সেরা হতে চেয়েছিলেন। দেশের ক্রিকেট তো বটেই, আন্তর্জাতিক মঞ্চেও তার রেকর্ড বিশ্বসেরাদের কাতারে। কিন্তু ক্যারিয়ারের কোনো পর্যায়ে সাকিব কি ভেবেছিলেন, নিয়তি তাকে এমন জায়গায় দাঁড় করাবে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *