* বিদেশে বিনিয়োগের বিষয়ে নেই কোনো অনুমোদন
* অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক
* আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী হিসেবে পরিচিতি
* শ্রমিক অসন্তোষে জড়িতদের একজন ব্যবসায়ী রাকিব
বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো অনুমোদন না নিয়ে বিজিএমইএ এর সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং টিম গ্রুপের ব্যস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুল্লাহিল রাকিব কানাডায় নিজে ও স্ত্রীর নামে তিনটি বাড়ি কিনেছেন। সেখানকার স্টক মার্কেটে রয়েছে তার বিশাল বিনিয়োগ। অথচ এসব বিনিয়োগের বিপরীতে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকসহ কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেননি। এমন অভিযোগ জমা হয়েছে ব্যবসায়ী এই নেতার বিরুদ্ধে। তার বিষয়ে ইতোমধ্যে প্রাক অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদকের গোয়েন্দা শাখা।
অভিযোগের বিবরণে দেখা যায়, কানাডার টরেন্টো সিটির ২৪, কিংসবারি ক্রেস এলাকা, ৯ ক্রিসেন্টউড এবং স্কারবোরাফের ৯ ইস্ট রোডে আব্দুল্লাহিল রাকিব ও তার স্ত্রী আফরোজা বেগমের তিনটি বাড়ি রয়েছে। দুদকে জমা হওয়া অভিযোগ ও গোয়েন্দা তথ্যমতে, মাত্র এক যুগ আগে বায়িং হাউজের সাধারণ কর্মী ছিলেন রাকিব। এখন তিনি বিশাল অর্থবিত্তের মালিক। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর ভাইস প্রেসিডেন্ট ও টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি। তার অধীনে দেশে রয়েছে গার্মেন্টস, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিসহ ডজনখানেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নানা উপায়ে উপার্জিত অর্থ পাচার করে কানাডায় বিনিয়োগ করেছেন রাকিব। চলতি বছর তিন বাড়ির বার্ষিক কর দিয়েছেন প্রায় ৩৫ হাজার ৪৩৭ কানাডিয়ান ডলার (৩১ লাখ টাকা)। আরও তিনটি বাড়ি তৈরির জন্য টরেন্টো সিটি কাউন্সিল কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমোদন চেয়ে ইতোমধ্যে আবেদনও করেছেন তিনি। কানাডার স্টক মার্কেটে তার বিপুল বিনিয়োগ থাকলেও বিদেশে বিনিয়োগ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো অনুমোদন নেননি তিনি। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, অবৈধভাবে পাচার করা অর্থে কানাডায় সম্পদের পাহাড় গড়েছেন এই ব্যবসায়ী নেতা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে খোঁজ নিয়েও আব্দুল্লাহ হিল রাকিব নামে কোনো ব্যক্তির বিদেশে বিনিয়োগ করার অনুমোদন সংক্রান্ত কোনো নথিপত্র পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, যেহেতু তিনি নিজের ও স্ত্রীর নামে সম্পদ করেছেন, সেহেতু বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও দুদক কার্যকর উদ্যোগ নিলে তার পাচারের অর্থ ফিরিয়ে আনা সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, আব্দুল্লাহ হিল রাকিব নামের কাউকে বিদেশে অর্থ বিনিয়োগের কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি।
প্রাপ্ত নথিপত্রে দেখা গেছে, কানাডার টরোন্টো শহরের বিলাসবহুল এলাকায় তিনটি অভিজাত বাড়ির মালিক আব্দুল্লাহ হিল রাকিব ও তার স্ত্রী আফরোজা শাহীন। টরেন্টো মেট্রোপলিটন ল্যান্ড রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল মতে- প্রতিটি বাড়ি নিজ ও স্ত্রীর যৌথ মালিকানায় কিনেছেন তিনি। এছাড়া আরও তিনটি বাড়ি ডেভেলপ করার জন্য তিনি টরেন্টোর সিটি কর্পোরেশনের কাছে আবেদন করেছেন। ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল আবেদনের শুনানি সংক্রান্ত নথিও পাওয়া গেছে।
কানাডার প্রপার্টি সংক্রান্ত দলিলে রাকিব দম্পতির বাড়ির বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, টরেন্টোর ২৪ কিংসবারিতে রাকিবের একটি বাড়ি রয়েছে। এই বাড়িটি টরেন্টো মেট্টোপলিটন রেজিস্ট্রি অফিস থেকে রাকিব ও তার স্ত্রী আফরোজা শাহীনের যৌথ নামে নিবন্ধন করা। ২০১২ সালের ৩০ মে কেনা বাড়িটির মোট আয়তন ৭ হাজার ৭৩০ স্কয়ার ফুট। বাড়ির আঙিনার পাশে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন সুইমিং পুল। গাড়ি রাখার জন্য আছে দুটি গ্যারেজ। চলতি বছর বাড়িটির বিপরীতে সাড়ে ১৮ হাজার কানাডিয়ান ডলার (১ লাখ ৬০ হাজার টাকা) কর পরিশোধ করেছেন রাকিব।
প্রাপ্ত নথিতে আরো দেখা যায়, রাকিব-আফরোজা দম্পতি ২০১৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর আরেকটি বাড়ি কিনেছেন টরেন্টোর ৯ ক্রিসেন্টউড রোডে। এটাও টরেন্টো মেট্রোপলিটনে রেজিস্ট্রি করা। সাগর সংলগ্ন বাগানে ঘেরা ৩২ হাজার স্কয়ার ফুট আয়তনের বাড়িটি কিনেছেন প্রায় ১৬ লাখ কানাডিয়ান ডলারে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ১৪ কোটি টাকারও বেশি। সবশেষ চলতি বছর বাড়িটির কর পরিশোধ করা হয়েছে ১১ হাজার ৪৩৭ কানাডিয়ান ডলার (১০ লাখ টাকার বেশি)।
রাকিব-আফরোজা দম্পতির আরেকটি বাড়িটির সন্ধান পাওয়া যায় স্কারবোরাফ এর ৯ ইস্ট সড়কে। এই বাড়ির মোট আয়তন ৪ হাজার ৪৯০ স্কয়ার ফুট। ২০১৮ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রায় আট লাখ কানাডিয়ান ডলারে (প্রায় পৌনে ৮ কোটি টাকা) তারা এই বাড়িটি কিনেছেন। চলতি বছরে বাড়িটির কর পরিশোধ করেছেন ৬ হাজার কানাডিয়ান ডলার (প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা)।
কানাডার বাংলাদেশ কমিউনিটির রিয়েল এস্টেট এজেন্ট সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশি কমিউনিটির কেউ বাড়ি বা ফ্লাট বিক্রি করলে প্রথমেই খোঁজ পড়ে তার। তিনি (রাকিব) যেহেতু আমদানি রফতানি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, সেহেতু আন্ডার ইনভয়েস এবং ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে অর্থ পাচার তার জন্য সহজ। তার প্রতিষ্ঠান থেকে রফতানি করা পণ্যের অর্থ প্রত্যাবাসিত হয়েছে কিনা সে খবর নিলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কানাডিয়ান স্টক মার্কেটে রাকিবের রয়েছে বিপুল বিনিয়োগ। এইচএসবিসি ব্যাংক হংকং থেকে রয়াল ব্যাংক অব কানাডায় অর্থ স্থানান্তর করা হয়। সেই অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে স্টক মার্কেটে। দুদকে জমা হওয়া অভিযোগের তথ্য মতে, দেশে রাকিবের ডজনখানেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের খোঁজ মিলেছি। তৈরি পোশাক শিল্পের বাইরেও বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে তার। অভিযোগ আছে- টিম ফার্মাসিউটিক্যাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে। রাজশাহীতে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানের নামে নেয়া ঋণের বেশিরভাগ অর্থ কানাডায় পাচার করা হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৫ সালে ‘ট্যাক্স ইবো’ নামের একটি বিদেশি বায়িং হাউজের কর্মী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন রাকিব। প্রতিষ্ঠানটির বড় অংকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। ঐ টাকায় ২০০৭ সালে রাকিব নিজ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। আওয়ামী লীগ নেতা এমএ মান্নান কচির আস্থাভাজন হিসেবে তিনি সংগঠনটির সহ-সভাপতির পদ পেয়ে যান। আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী যেসব গার্মেন্টস ব্যবসায়ী অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে শ্রমিক অসন্তোষ জিইয়ে রাখার অপচেষ্টা করছেন, রাকিবও তাদের একজন। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে শ্রমিক অসন্তোষের নেপথ্যে অর্থ বিনিয়োগের তথ্যও সরকারের উচ্চ মহলকে অবহিত করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা।
জানা গেছে, রাকিবের জন্ম ১৯৭১ সালে। তার প্রতিষ্ঠিত টিম গ্রুপের মধ্যে রয়েছে টিম সোর্সিং লিমিটেড, গ্রামটেক নিট ডায়িং ফিনিশিং অ্যান্ড গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ, সাউথ অ্যান্ড স্যুয়েটার কোম্পানি লিমিটেড, ব্রাদার ফ্যাশন লিমিটেড, ফোর এ ইয়ার্ন ডায়িং লিমিটেড, টিম ফার্মাসিউটিকাল লিমিটেড, মারস স্টিচ লিমিটেড, টিন এক্সেসরিজ লিমিটেড, টুয়েলভ ক্লদিং, ফার্মা আইএমইএক্স লিমিটেড, ইনটেলার লিমিটেড ও টিম ডেভেলপার লিমিটেড।
আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য তার মোবাইল ফোন নম্বরে কয়েক দফা ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
টিম গ্রুপের একজন কর্মকর্তা বলেন, আব্দুল্লাহ হিল রাকিবের কানাডায় তিনটি নয়, দুটি বাড়ি আছে। একটি বিক্রি করে দিয়েছেন। সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য পরিবারের সদস্যরা সেখানে থাকেন। রাকিব আগে কানাডা প্রবাসী ছিলেন। ওখানে ২ লাখ ডলার ঋণ নিয়ে বাড়ি কিনেন। ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, কানাডা থেকে এসে বায়িং হাউজ ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ২০০৮-২০০৯ সালের দিকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তিনি কয়েকটি কারখানা ক্রয় করেন। তবে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির নামে তার কোনো ব্যাংক ঋণ নেই।
Leave a Reply