হাসিনার বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও কেন বিমান পাঠায়নি ভারত!

শেখ হাসিনাকে অনেকে গত এক যুগ ধরে ‘আয়রন লেডি’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। সাড়ে ১৫ বছর যাবৎ দোর্দণ্ড প্রতাপে ক্ষমতায় টিকে থাকা একজন প্রধানমন্ত্রী এভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবেন সেটি অনেক ধারণাই করতে পারেননি। বাংলাদেশের ইতিহাসে ক্ষমতাচ্যুত হবার পর কোনো ব্যক্তি এভাবে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হননি।

ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা প্রতিবেশী দেশ ভারতে পলিয়ে যেতে বাধ্য হন। তবে তার পালিয়ে যাওয়ার আগে রোববার রাত এবং সোমবার সকাল থেকে নানা নাটকীয়তা হয়েছে।

৫ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত দফায় দফায় নিরাপত্তা চেয়ে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে শেখ হাসিনা আলোচনা করেন। তাদের তিনি বলেছিলেন, ঢাকার কোনো বিমানে চড়তে তিনি নিরাপদ বোধ করছেন না। এরমধ্যে নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল অন্যতম। দোভালকে হাসিনা একাধিকবার বলেন, ‘আমি দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই মুহূর্তে আমার সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। কারণ জনগণের পাশাপাশি সেনাবাহিনীও আমার বিরুদ্ধে চলে গেছে। এই অবস্থায় প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছাড়তে হবে। তাই ভারত যদি বিমান পাঠায় তাহলে আমি নিরাপদে দেশত্যাগ করতে পারবো।’

তবে হাসিনার অব্যাহত অনুরোধ সত্ত্বেও ভারত থেকে বিমান আসেনি। কেন ভারত বিমান পাঠায়নি- তা নিয়ে এখনও বিস্তর আলোচনা রয়েছে।

জনশ্রুতি রয়েছে, হাসিনার এই অনুরোধের প্রেক্ষিতে দোভাল নাকি বলেছেন, আমরা দেখছি কী করা যায়। দিল্লিতে তখন এ নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ে বৈঠকও বসে। নেওয়া হয় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতও। এরপর বলা হয়, ভারতের পক্ষে নানা কারণে বিমান পাঠানো ঠিক হবে না। বাংলাদেশকে বলা হোক, তারা নিজ দায়িত্বে যেন শেখ হাসিনাকে নিরাপদে দিল্লি পাঠিয়ে দেয়। ঢাকা তখন অগ্নিগর্ভ। যেকোনো মুহূর্তে বিক্ষুব্ধ জনতা গণভবন দখল করে নিতে পারে। এমনকি সেনানিবাসে নেওয়ার পরও পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় তা নিয়েও চিন্তিত হয়ে পড়েন সেনা নেতৃত্ব। এমন অবস্থায় হাসিনার নিরাপত্তা দেওয়া সেনাবাহিনীর পক্ষে কঠিন হবে। এই বিক্ষুব্ধ জনস্রোত মোকাবিলা করতে গেলে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটবে।

ওদিকে ভীত সন্ত্রস্ত হাসিনাও দেশ ছাড়ার ব্যাপারে মরিয়া। বারবার সেনাপ্রশাসনকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ জানান। বলেন, যে করেই হোক তাকে যেন তারা দ্রুত দিল্লি পাঠানোর ব্যবস্থা নেয়। জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বিষয়টি নিয়ে তার সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। সবাই তখন একবাক্যে হাসিনাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে একমত হন। এর পরেই বাংলাদেশের নিজস্ব বিমানে হাসিনাকে দিল্লি পাঠানো হয়।

প্রশ্ন হচ্ছে, হাসিনাকে নিতে ভারত কেন বিমান পাঠালো না। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ভবিষ্যৎ রাজনীতির কথা ভেবে তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারতীয় নেতৃবৃন্দ তখন যুক্তি দেখিয়েছিলেন, হাসিনাকে যদি ভারত তার নিজস্ব বিমানে উঠিয়ে নিয়ে যায় তখন আন্তর্জাতিক মহলে নানা প্রশ্ন উঠবে।

বলা হবে- একটি রাষ্ট্র থেকে এভাবে তৃতীয় আরেকটি দেশ ক্ষমতাচ্যুত কোনো প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীকে নিরাপত্তার নামে উদ্ধার করলে দেশটির স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। এমনিতেই বাংলাদেশের মানুষ ভারতবিরোধী। এ ছাড়া অন্য একটি কারণও ছিল। ভারত প্রমাণ করতে চেয়েছিল- বাংলাদেশই তাদের প্রধানমন্ত্রীকে এভাবে পুশ করেছে।

একটি দায়িত্বশীল কূটনৈতিক সূত্র জানায়, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতায় ভারত নাকি হুমকিও দিয়েছিল- যদি তারা হাসিনাকে দ্রুত না পাঠায় তাহলে বিকল্প কঠিন ব্যবস্থার কথা ভাবা হবে। হাসিনা দেশ ছাড়ার আগে হাতে তিন পৃষ্ঠার একটি লেখা লিখেছিলেন। তখন তিনি তার প্রেস টিমের একজন সদস্যের সঙ্গে কথাও বলেন। এই সদস্য এখন আত্মগোপনে রয়েছেন। লেখাটা হাসিনা রেখে যাননি। ভ্যানিটি ব্যাগে করেই তা নিয়ে যান দিল্লিতে। সেখানে পৌঁছার পর ওইদিন রাত ১২টার দিকে ঢাকায় তার কয়েকজন বিশ্বস্ত সহকর্মীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। তখন এই লেখার প্রসঙ্গটি আসে। যা নিয়ে বিস্তারিত জানা সম্ভব হয়নি।

তথ্যসূত্র: জনতার চোখ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *