‘মানবাধিকারকর্মী’ পরিচয়েই স্বাচ্ছন্দ্য তার। যদিও তার ‘মানবাধিকার’র সংজ্ঞাটা একটু ভিন্ন। তিনি যাদের ‘অধিকার রক্ষা’য় সোচ্চার, তাদেরকে প্রথমত, হতে হয় আ’লীগার। দ্বিতীয়ত, তাকে হতে হয় কমবয়সী নারী। এবং সেই নারী কোনোক্রমেই হিজাব কিংবা বোরকা পরা হলে চলবে না। তিনি বিনা ফি’তে আইনি সহায়তা দেন, যদি তার নাম হয় ‘পরীমনি’। বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় তিনি বারবার আদালতে দাঁড়ান আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির হয়ে। নিহত রিফাত শরীফের পিতার আইনজীবী হিসেবে নন। আবার শাপলা চত্বরে হেফাজত সমাবেশে আলেম ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো গণহত্যাকে তিনি ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতেও নারাজ। হাসিনার শাসনামলজুড়ে যত গুম-খুন-বিচার বহির্ভূত হত্যা হয়েছে সে বিষয়ে তিনি চুপ। বিডিআর পিলখানায় সেনা হত্যা নিয়েও তার কোনো কথা নেই। দিনের ভোট রাতে কিংবা ডামি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তার নেত্রীর বারবার ক্ষমতায় আসায় তার কোনো আপত্তি নেই। এহেন ‘মানবাধিকার কর্মী’ আর কেউ নন। হালের শোরগোল তোলা অ্যাডভোকেট জেড.আই. (জহিরুল ইসলাম) খান পান্না।
ভারতমুখী মিডিয়ার কল্যাণে এই আওয়ামী থিংকট্যাঙ্ক পেশাজীবীদের মাঝে মিশে আছেন ‘নিরপেক্ষ’ ও ‘সুশীল’ হয়ে। মূলত, তিনি সাচ্চা আওয়ামীলীগার। যে কারণে তার নেত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলেও সুশীল পরিচয়ে জেড.আই. খান দিব্যি আছেন এদেশেই। ফ্যাসিবাদের ক্ল্যাসিক্যাল দোসর হয়েও আত্মগোপনে যেতে হয়নি তাকে। কারণ, হাসিনার বুলেটের গুলিতে যখন শত শত ছাত্র-জনতা অকাতরে প্রাণ দিচ্ছিলেন, তখন শেষ দিকে তিনি নাকি ‘ছাত্রদের পক্ষে’ দাঁড়িয়েছিলেন! তবে ঝোঁপ বুঝে কোপ মারা এই আইনজীবীর প্রকৃত চেহারা বিকশিত হয়েছে প্রবাসী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসাইনের এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে। জেড.আই.খান পান্না কেন নিরপেক্ষতার ভাণ ধরে ‘সুশীল’ হয়ে মিশে থাকেন পেশাজীবীদের মাঝেÑ এর জবাব রয়েছে এ প্রতিবেদনে। তিনি মূলত, হাসিনা এবং ভারতীয় লবির এজেন্ট হয়ে কাজ করেন। গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে মানুষের মাঝে বিভ্রম সৃষ্টির লক্ষ্যেই তিনি সুশীল সাজেন। এতে অবশ্য সফলও হয়েছেন। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে গণহত্যার বিচারকল্পে গত ২৩ সেপ্টেম্বর ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন’র সংশোধনী খসড়া’র ওপর একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত এ সভায় সভাপতিত্ব করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন,বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। সেখানে ৮টি খসড়া প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। সেখানে দেখা মেলে জেড.আই.খান পান্না নামের ‘সুশীল’কে। খসড়া প্রস্তাবনায় যথারীতি তিনি ভিন্নমত পোষণ করেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনা এবং তার দোসরদের পরিচালিত গণহত্যার বিচার প্রশ্নে নিজের অবস্থান জানান দেন।
গত ১৭ অক্টোবর রাজধানীর খিলগাঁও থানায় একটি মামলা হয়। ওই মামলায় জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে গুলিতে আহত আহাদুল ইসলামের পিতা মো: বাকের একটি ‘হত্যাচেষ্টা’ মামলা দায়ের করেন। এ মামলার আসামি ছিলেন জেড.আই. খান পান্না। কিন্তু অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের (ভারতীয় লবি) কয়েকজন উপদেষ্টাদের মাঝে পান্নার প্রভাবের শেকড় এতোটাই গভীরে প্রোথিত যে, তিন দিনের মধ্যে (২০ অক্টোবর) আগাম জামিন পেয়ে যান। ২১ অক্টোবর মামলা থেকে তার নামও প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু ক’দিন পরই হত্যাচেষ্টা মামলা থেকে বেঁচে যাওয়া জেডআই খান পান্না বেরিয়ে আসেন খোলস ছেড়ে। ২১ নভেম্বর তিনি ‘সুযোগ পেলে’ ফ্যাসিস্ট হাসিনার পক্ষেও আইনি লড়াই করার ঘোষণা দেন। এখানে তিনি যুক্তি হিসেবে হাজির করেন সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ। যেখানে বলা আছে, ‘বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিক যেকোনো স্থানে অবস্থানরত অবস্থায় আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার রাখে।’ হাজির করেন আইনজীবী হিসেবে ‘পেশাদারিত্ব’র তত্ত্ব। যদিও এ ঘোষণা দিয়ে নেটিজেনদের তোপের মুখে পড়েন তিনি। তবে পূর্ণ স্বরূপ উন্মোচিত হয় প্রবাসী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসাইনের প্রতিবেদনে। যেখানে অ্যাডভোকেট জেড.আই. খান পান্নার নেতৃত্বে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উৎখাতে সশস্ত্র গেরিলা হামলা পরিকল্পনার প্রমাণ মেলে।
জেড আই খান পান্নাকে ভারতমুখী মিডিয়া ‘নিরপেক্ষ’ এবং ‘সুশীল’ হিসেবে পরিচয় করালেও তিনি কার্যত, ইসলাম বিদ্বেষী আওয়ামীলীগার। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের ঘোর সমর্থক। সব সময় ভোগেন ইসলাম ফোবিয়ায়। ‘ইসলাম’ বলতেই তিনি বোঝেন ‘মৌলবাদ’। রাজনৈতিকভাবে তিনি প্রচ- বিএনপি বিরোধী। যেসব কারণে তাকে ‘সুশলী’দের অন্তর্ভুক্ত মনে করা হয় তার একটি হচ্ছে, জেড আই খান পান্না লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট’ (ব্লাস্ট)র একজন ট্রাস্টি। ছিলেন আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের লিগ্যাল এইড কমিটি’র চেয়ারম্যান।
২০১৪ সালের নভেম্বরে তিনি বাংলাদেশের সংবিধান লঙ্ঘন করে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে লাভজনক পদে থাকার কারণে পদত্যাগ করার জন্য তিন মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং জাহিদ মালেককে লিগ্যাল নোটিশ দেন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এসব কর্মকা- তাকে ‘রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা’র মুখোশ উপহার দেয়। বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে সহায়ক হয় জনমনে। কিন্তু তিনি কখনোই সরাসরি শেখ হাসিনার সমালোচনা করেননি। পক্ষান্তরে বিএনপিকে কোণঠাসা করতে তার জুড়ি মেলা ভার। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট বোমা হামলায় জড়িতদের গ্রেফতারে ব্যর্থতার ব্যাখ্যা চেয়ে বার কাউন্সিলের পক্ষে একটি পিটিশন দায়ের করেন। বিএনপি আমলের ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’র সঙ্গে জড়িত নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের অধ্যাদেশ চ্যালেঞ্জ করেন। ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে বাংলাদেশে কথিত ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা’ তদন্তের আহ্বান জানান। এর আগে শেখ মুজিব হত্যার বিচার রোধে জারিকৃত ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’র বাতিলের পক্ষে কাজ করেন। অথচ বিদ্যুৎ খাতে দেড় দশকের লুটপাট-দুর্নীতির তদন্ত রোধকল্পে হাসিনা যে ‘ইনডেমনিটি’ আরোপ করেন সে সম্পর্কে তিনি টুঁ শব্দ করেননি। হাসিনার শাসনামলে শত শত নিরীহ আলেম এবং মাদরাসা শিক্ষার্থীদের নানা ছুঁতোয় কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। ‘জঙ্গি’ তকমা দিয়ে রিমান্ডে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করা হয়। বিচারের আগেই আলেমদের পায়ে পরানো হয় ডা-াবেড়ি। এসবের মাঝে কোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন দেখতে পাননি জেড আই খান। এমনকি দিনের ভোট রাতে, ডামি নির্বাচনসহ হাসিনার লুটপাটতন্ত্রের সরাসরি কোনো সমালোচনায়ও দেখা যায়নি ‘সুশীল’ ও ‘নিরপেক্ষতা’র জ্যাকেটধারী আওয়ামী আইনজীবী জেড.আই.খান পান্নাকে।
Leave a Reply