৫ আগস্ট ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দেড় দশকের শাসনামলে সংঘটিত দুর্নীতি ও লুটপাটের বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির খসড়া প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উন্নয়ন বাজেটের ৪০ শতাংশ অর্থ তছরুপ বা লুটপাট হয়। পাশাপাশি এ অর্থ থেকে প্রতিবছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার বা এক লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়।
এছাড়া বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকে রাষ্ট্রীয় মদদে ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাটের চিত্রও তুলে ধরা হয় এই প্রতিবেদনে। ২৮টি উপায়ে এসব দুর্নীতি সংঘটিত হতো বলেও উঠে আসে শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ২৮ আগস্ট ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত হয় ১১ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র প্রস্তুতি কমিটি। কমিটি গঠনের তিন মাসের মাথায় ১ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে শ্বেতপত্রের প্রতিবেদন তুলে দেয়া হয়।
শ্বেতপত্রে বলা হয়, নিয়ন্ত্রণহীন দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে জনগণের সম্পদের লুটপাটের মাধ্যমে দেশে ’লুটেরা বা চোর তন্ত্র’ তৈরি করা হয়। এই এই অপশাসনের ক্ষেত্র তৈরি হয় গণতন্ত্রহীনতার মাধ্যমে যার ভিত্তি রচিত হয় ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জালিয়াতির মাধ্যমে সংঘটিত নির্বাচনের মাধ্যমে। নজিরবিহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। প্রতিবছর পাচার করা অর্থের পরিমাণ ছিল গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার।
খসড়া শ্বেতপত্রের ভূমিকায় ’দুর্নীতির ইশতেহার’ শীর্ষক অংশে বর্তমান সরকারের কাঁধে রেখে যাওয়া দুর্দশাগ্রস্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে বিগত সরকারের সময়ে হওয়া বিস্তৃত ও গভীর দুর্নীতির ইশতেহার হিসেবে উল্লেখ করেন শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। বিশেষ করে জনগণের সম্পদের অব্যবস্থাপনাকেই এই দুর্নীতির অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির অনুসন্ধানে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২৮টি প্রধান উপায়ে দুর্নীতি সংঘটনের চিত্র উঠে আসে বলে উল্লেখ করেন ড. দেবপ্রিয়। যে সব উপায়ে বিগত সরকারের আমলে এ সব দুর্নীতি সংঘটিত হতো তাতে প্রথমেই উল্লেখ করা হয় দেশের আর্থিক খাতের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাকে। সেখানে বলা হয়, প্রতারণাপূর্ণ ব্যাংকঋণের ব্যাপক প্রসারের মাধ্যমে ঋণের অর্থ আত্মসাত করা হয় বিগত সরকারের আমলে।
পাশাপাশি আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে জোর করে ব্যাংক দখল করা হয়েছে উল্লেখ করে শ্বেতপত্র কমিটি বলছে, ব্যাংক দখলের ক্ষেত্রে নেয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয় সংস্থার সহায়তা।
এছাড়া অবৈধভাবে অর্থ পাচারের মাধ্যমে বিদেশি অর্থপাচার করা হয় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। আর পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল বিপুল।
দুর্নীতির অন্যতম ক্ষেত্র হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেয়া অলাভজনক প্রকল্প। লাভজনক হবে না জেনেও এসব প্রকল্পে সম্পদের অপচয় করা হয়। সময়মতো এসব প্রকল্প শেষ করা হয়নি। এই প্রকল্পগুলোতে বিপুল অর্থ ব্যয় মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
দুর্নীতির আর একটি উপায় ছিল প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধি। এ সব প্রকল্পের খরচ ইচ্ছামতো বাড়িয়ে দেখানো হয় যেন টাকা চুরি করা সম্ভব হয়।
পাশাপাশি প্রকল্প অনুমোদনের পর বিভিন্নভাবে ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদনের পর কৃত্রিমভাবে ব্যয় বৃদ্ধির উদ্দেশ্য ছিল তহবিলের অর্থ আত্মসাৎ করা।
প্রতিযোগিতাবিহীন দরপত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকারি কেনাকাটা করা হয়। যেন স্বজনপ্রীতি করা সম্ভব হয়। এর মাধ্যমে সুবিধাপ্রাপ্তরা লাভবান হয়। যোগ্য সরবরাহকারীদের দরপত্র প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়।
এছাড়া নেয়া হয় অপ্রয়োজনীয় ও দুর্বল প্রকল্প। প্রকল্পগুলো নেয়ার সময় যেনতেনভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। এভাবে সম্পদের অপচয় হয়েছে। প্রকল্প যথাসময়ে শেষ হয়নি, যার ফলে বেড়েছে খরচ।
দুর্নীতির অন্যতম ক্ষেত্র ছিল নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি। প্রকল্পের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, বিশেষ করে যারা প্রকল্প পরিচালক হিসেবে পেতেন, রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগই ছিল তাদের নিয়োগের মাপকাঠি। এ ক্ষেত্রে মেধার বিচার করা হত না।
অবৈধভাবে জমি ও সম্পদের অধিগ্রহণের মাধ্যমে দুর্নীতি সংঘটন হয়। ভূমি ও সম্পদ জব্দ কিংবা অধিগ্রহণ করা হয় বেআইনি পন্থায়।
ভূমি অধিগ্রহণের জন্য বরাদ্দ তহবিলের অপব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি যেসব ভূমিমালিকের রাজনৈতিক যোগাযোগ শক্তিশালী ছিল না, তাদের বাধ্য করা হয় অসম চুক্তিতে যেতে। এভাবে অধিগ্রহণের জন্য বরাদ্দ দেয়া অর্থের অপব্যবহার করা হয়েছে।
দরপত্রের চুক্তিমূল্য বৃদ্ধি করে পুরষ্কৃত করা হয়। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ঠিকাদাররা যে সব সরকারি কাজ বরাদ্দ পেতেন সেগুলোর মূল্য বাড়িয়ে দেয়া হতো। আর এসব বরাদ্দ হত কোনো ধরনের প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়াই।
প্রকল্পের সম্পদের অপব্যবহারের মাধ্যমেও দুর্নীতি সংঘটিত হয়। এভাবে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সুবিধার জন্য যানবাহন, ভ্রমণ বাজেট এবং প্রকল্পের অন্যান্য সম্পদের অপব্যবহার করা হয়।
ঘুষকে করা হয়েছিল সব কাজের মানদণ্ড। কাজ এগিয়ে নিতে এবং বিশেষ সুবিধার বিনিময়ে নিয়মিতভাবে ঘুষের লেনদেন হতো।
রাষ্ট্রীয় তহবিলের অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দের মাধ্যমেও দুর্নীতি সংঘটিত হয। উন্নয়নকাজের জন্য বরাদ্দ করা অর্থ অন্য কাজে ব্যবহার করা হত। এর উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক নেতাদের রাজনৈতিক অথবা ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য পূরণ।
প্রভাবশালীদের কর অব্যাহতি দেয়া হতো। এছাড়া কর নীতিও অন্যায়ভাবে প্রভাবশালীদের সুবিধা দিতো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে।
সরবরাহ চেইনকে বিঘ্নিত করার মাধ্যমে পুরো সরবরাহ ব্যবস্থাকে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, যার জেরে পণ্যমূল্য অন্যায্যভাবে বৃদ্ধি পায় এবং বাজারে অদক্ষতা সৃষ্টি হয়।
রাষ্ট্রের গোপন তথ্য আদান–প্রদানের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীর কাছে নীতিসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত ফাঁস করে দেয়া হতো, যাতে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে।
সংঘবদ্ধ দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা ও সুবিধাভোগীরা। এভাবে আঁতাতের মাধ্যমে তারা উভয়েই লাভবান হন।
চাঁদাবাজিভিত্তিক দুর্নীতি ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংঘটিত দুর্নীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এভাবে ঘুষ আদায় কিংবা অন্যায্য লেনদেনে যেতে চাপ প্রয়োগ করা হতো।
একচেটিয়া ব্যবস্থার মাধ্যমে দুর্নীতি সংঘটন হতো। এর মাধ্যমে বাজার পরিস্থিতি এমনভাবে পরিচালনা করা হতো, যেন বিশেষ ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান লাভবান হয়।
দুর্নীতি সংঘটনের আরেকটি প্রধান উপায় ছিল তথ্য লেনদেন। এর মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আগেই জানিয়ে দেয়া হত, ফলে বিশেষ গোষ্ঠী সুবিধা পেত।
শুধু তথ্য পাচারই নয় বরং তথ্য গোপন করার মাধ্যমেও দুর্নীতি করা হত। অংশীজনের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন রাখা হতো, যেন তারা বিভ্রান্ত হয়।
নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমেও দুর্নীতি সংঘটিত হতো। এভাবে ঘুষ পাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করতে অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করা হত।
পদোন্নতির জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হতো। পদোন্নতি কিংবা গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাওয়ার মাধ্যম ছিল ঘুষ ও যোগাযোগ।
কমিশনের ভাগাভাগি হত, কোনো বিষয় অনুমোদন দেয়ার জন্য ভাগ চাইতেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
রাজনৈতিক সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে দুর্নীতির বিষয়টিও উঠে আসে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির অনুসন্ধানে। রাজনৈতিক আনুগত্য কিংবা সুবিধা পাওয়ার জন্য সম্পদের ব্যবহার ও সিদ্ধান্ত নেয়া হত। শুধু তাই নয়, আইন ও নীতি এমনভাবে প্রণয়ন হতো, যা সুবিধা দিতো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে।
Leave a Reply