যেকারণে চিন্ময় দাসের জামিন শুনানিতে আইনজীবী ছিলেন না, জানাগেলো আসল কারণ!

সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় দাসের জামিন শুনানিতে মামলা, হামলা এবং প্রাণনাশের হুমকির মুখে কোনো আইনজীবীকে তার পক্ষে আদালতে দাঁড়াতে দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। আর জামিনের শুনানির জন্য চিন্ময় দাসকে আদালতে হাজির করা হয়নি। এমন প্রেক্ষাপটে জামিন আবেদনের শুনানি এক মাস পিছিয়ে দিয়েছে চট্টগ্রামের মহানগর দায়রা জজ আদালত।

গত ২৬ নভেম্বর চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিনকে ঘিরে সংঘর্ষ, ভাঙচুর এবং আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ নিহত হওয়ার পরে করা এক মামলায় ৭০ জন হিন্দু আইনজীবীকে আসামি করা হয়েছে। এ মামলায় চিন্ময় দাসের জামিন আবেদনকারী আইনজীবীকেও আসামি করা হয়েছে। এছাড়া তার পক্ষে আদালতে শুনানি করতে পারেন এমন হিন্দু জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরাও এসব মামলার আসামি।

চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যা মামলা এবং এ সংক্রান্ত কোনো মামলাগুলোতে যাতে কোনো আইনজীবী অংশ না নেন সে বিষয়ে অনুরোধ করা হয়েছে। ফলে এসব মামলায় অন্য আসামিদের জামিনের পক্ষে যেসব আইনজীবী ওকালতনামা দিতে যাচ্ছেন তারাই এক ধরনের চাপ ও হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন বলে জানা গেছে।

আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিনের দাবি কোনো আইনজীবীর ওপর হুমকি বা নিরাপত্তাজনিত কোনো ধরনের সংশয় ছিল না ও নাই।

ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো আসামির পক্ষে আইনজীবীকে লড়তে না দিলে তার আইনি অধিকার বিঘ্নিত হয়।

এদিকে, চিন্ময় দাসের গ্রেপ্তার ও আইনি অধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপ-মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল বলেছেন, যারা অপরাধে অভিযুক্ত তাদেরও উপযুক্ত আইনি সুযোগ দিতে হবে এবং মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার রক্ষা করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন বেদান্ত প্যাটেল।

রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের পর গত ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের সিএমএম কোর্ট জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিলে চিন্ময় দাসের অনুসারীদের বিক্ষোভের মুখে ওইদিন তাকে আদালত থেকে কারাগারে নিতে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লাগে।

একপর্যায়ে সংঘর্ষে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ নিহত হন। আহত হন অন্তত ৩০ জন। ওই দিনই চিন্ময় দাসের আইনজীবীরা এ আদেশের বিরুদ্ধে মহানগর দায়রা জজ আদালতে আবেদন করে জামিন চায়। কিন্তু সেদিন শুনানি হয়নি। তেসরা ডিসেম্বর শুনানির দিন ঠিক করা হয়েছিল। ওইদিন বিকেলে আইনজীবী আলিফ নিহতের বিষয়টি জানাজানি হলে পরবর্তী দুই দিন কর্মবিরতি পালনের ঘোষণা দেয় চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতি।

এসব প্রতিবাদ কর্মসূচি থেকে চিন্ময় দাসকে সব মামলায় আসামি করার দাবি জানানো হয়। আবার আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকেও আসামিদের পক্ষে কোনো আইনজীবী না দাঁড়াতে আহ্বান জানানো হয়। আইনজীবীদের গ্রুপেও এ বিষয়ে পোস্ট দেয়া হয়। পরে পহেলা ডিসেম্বর থেকে চট্টগ্রাম আদালতের স্বাভাবিক বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়।

এরপর জানা যায় চিন্ময় দাসের জামিন শুনানির দিন ৩ ডিসেম্বর মঙ্গলবার। কিন্তু রবিবার পুলিশের কাজে বাধাদানের অভিযোগে করা এক মামলায় একজন আসামি মুফতি আহমদ হোসাইনের আইনজীবী কাজী মফিজুর রহমান ওকালতনামা জমা দিয়ে তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। কারণ হিসেবে জানা যায়, এ ঘটনার কোনো মামলায় আইনজীবীদের না লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইনজীবী সমিতি।

এ বিষয়ে ফেসবুকে এক পোস্টে মফিজুর রহমান লিখেছেন, যেহেতু ঐ তিন মামলায় ওকালতনামা না দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে তাহলে আমি ঐ ওকালত নামার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি এবং প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।

তিনি বলেন, ‘জামিন চাওয়া যদি অপরাধ হয় আমি বারের পেইজে বলছি যে তাহলে আমি জামিন চাইবো না, প্রত্যাহার করে নিব। ওকালত নামা দেয়াটা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। বাংলাদেশের বার কাউন্সিলের রুলসে আছে। কেউ বাধা দেয় নাই, আজকে সকালে ফেসবুকে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে যে আমি আলিফ হত্যা মামলার মধ্যে ওকালতনামা দিয়েছি।’

মফিজুর রহমানের বক্তব্য অনুযায়ী, নিহত আইনজীবী আলিফ তারই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই। স্বার্থান্বেষী মহল এ বিষয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে। কারণ যে মামলায় আসামির পক্ষে তিনি আইনজীবী হতে গিয়েছেন সেটি পুলিশের করা মামলা। আলিফ হত্যা মামলা পৃথক আরেকটি মামলা।

তিনি বলেন, ‘যেহেতু পুলিশের ওই মামলায় অজ্ঞাত ২১০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ মামলায় একজন সিনিয়র অ্যাডভোকেট কাইয়ুম জেল খাটতেছে দশ দিন। তাহলে আমি, আপনি কেউতো এখানে নিরাপদ না। এগুলা-তো আলিফ হত্যা মামলা না।’

তিনি জানান, আইনজীবী হত্যা মামলায় সবাই হিন্দু আসামি, মুসলিম নেই। আর পুলিশের করা ভাঙচুর মামলায় চিন্ময় দাসকে আসামিও করা হয় নাই।

২৬ নভেম্বরের ঘটনায় যেসব মামলা হয়েছে তাতে আসামিদের পক্ষে না দাঁড়াতে এক ধরনের চাপ রয়েছে কি না এমন প্রশ্নে এই আইনজীবী বলেন, ‘অবশ্যই, অবশ্যই। না হলে বার কাউন্সিলের রুলস এন্ড অর্ডারের মধ্যে একজন আইনজীবী আসামির পক্ষে ওকালতনামা দেবে এটা স্বাভাবিক। মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। আমিই নিরাপদ না, আমার স্ত্রী, আমার বউ, আমার বাচ্চা নিরাপদ না।’

পুলিশের কাজে বাধাদানের এসব মামলায় ভিডিও দেখে শনাক্ত করে আসামি করতে পুলিশের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। সোমবার ২ ডিসেম্বরও একই ঘটনা ঘটে। এদিন পুলিশের ওপর হামলার মামলায় দুই জন আসামি দেলোয়ার হোসেন এবং মো. নুরুর পক্ষে অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর নেজাম উদ্দিনের নামে আদালতে ওকালতনামা জমা দেয়া হয়। পরে আইনজীবীদের বিক্ষোভের মুখে ওকালতনামা প্রত্যাহার করা হয়।

মঙ্গলবার চিন্ময় দাসের জামিন আবেদনের শুনানির আগেও আদালত চত্বরে বিক্ষোভ করে আইনজীবীরা। হামলা, ভাঙচুর ও হত্যা মামলার কোনটিতেই চিন্ময় দাসকে আসামি না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা। মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের অন্তত একশত আইনজীবী এ দিন আদালতে উপস্থিত ছিল। আইনজীবী সমিতির নেতারাসহ অনেক আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন।

পরে দেখা যায় জামিন আবেদনের শুনানির জন্য আদালতে চিন্ময় দাসের পক্ষে কোনো আইনজীবী উপস্থিত নেই। সময় আবেদনও করেননি চিন্ময় দাসের আইনজীবীরা। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর মফিজুল হক ভুঁইয়া সময় আবেদন করেন।

একইসাথে চিন্ময় দাসের পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকায় পরবর্তী শুনানি দোসরা জানুয়ারি হবে বলে নির্ধারণ করে আদালত।

মফিজুল হক ভুঁইয়া বলেন, ‘আসামির পক্ষে কেউ রেসপন্স না করায় আমি টাইম পিটিশনের কথা বললাম যে এটা গুরুত্বপূর্ণ মামলা, সেনসিটিভ মামলা। পরে উনি একটা তারিখ দিলেন। দরখাস্ত পেন্ডিং আছে। নামঞ্জুর করেনি আদালত। ওইদিন ওনারা আসলে শুনানি হবে।’

তিনি জানান, এর আগের দিন অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটরের আসামিদের পক্ষে ওকালতনামা দেয়ার যে ঘটনা ঘটেছে এটি তার ইমেজকে খর্ব করার জন্য করা হয়েছে।

আসামিদের পক্ষে মামলা লড়তে আইনজীবীদের ওপর চাপ রয়েছে কি না এ প্রশ্নে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘সমিতির পক্ষ থেকে আমরা অনুরোধ করেছি আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যাকাণ্ড ও এই সংক্রান্ত অন্য মামলাগুলোতে যেন কোনো আইনজীবী আসামিদের পক্ষে না দাঁড়ান। বিশেষ করে হত্যা মামলাতে অংশ না নিতে আমরা বেশি বলছি। অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর নেজাম উদ্দিন কালকে একটি আবেদন করছে যে ওকালতনামার বিষয় নিয়ে সে ভিকটিমাইজ হয়েছে। সে এটা দেয় নাই। তার চেম্বারের একজন জুনিয়র দিয়েছে।’

চিন্ময় দাসের আইনজীবীদের নিরাপত্তাহীনতার কথা উল্লেখ করলে সমিতির সভাপতি এবং মহানগর দায়রা আদালতের পিপি দুইজনই অভিযোগ নাকচ করে দেন। তবে এ ধরনের আবেদনের ক্ষেত্রে আইনজীবী না থাকলে মামলাটি শুধুমাত্র নথি-জাত করে রাখা হয়।

আইনজীবী না থাকা নিয়ে সনাতনী জোটের বক্তব্য:

কেন আইনজীবীরা চিন্ময় দাসের মামলা লড়তে আদালতে ছিল না এর কারণ সম্পর্কে সম্মিলিত সনাতনী জোটের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি আইনজীবী সুমন কুমার রায় বলেন, ‘আইনজীবী ছিল না তা নয়, কোনো আইনজীবীকে আদালতে দাঁড়াতে দেয়া হয় নাই। সেখানে প্রতিরোধের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল।’

গত দুই দিন বিভিন্ন মামলায় আসামিদের পক্ষে আদালতে শুনানি করতে গেলে বাধার সম্মুখীন হয় আইনজীবীরা এবং সমাবেশ করে যারা লড়বে তাদের গণপিটুনি দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয় বলে দাবি করেন সুমন কুমার রায়।

তিনি বলেন, ‘এখানে তো প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়েছে। হুমকি নিয়ে সে কীভাবে দাঁড়াবে আদালতে। এর আগে হিন্দু আইনজীবীদের চেম্বারও ভাঙচুর করা হয়েছে।’ সবকিছু মিলিয়ে একটা ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে যে কোন আইনজীবী সেখানে দাঁড়াতে পারেনি বলে তার দাবি।

তিনি আরো বলেন, ‘আর এটি নামঞ্জুর হলে মামলা প্রত্যাহারের পিটিশন দিব। মামলা প্রত্যাহার হলে নিম্ন আদালতে শুনানির উদ্যোগ নেয়া হবে। যদি সেখানেও নামঞ্জুর হলে হাইকোর্টে আবেদন করা হবে।’

রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র দাবি করে সুমন কুমার বলেন, ‘রাষ্ট্রীয়ভাবেই সে যাতে ন্যায়বিচার না পায়, তাকে যাতে জেলখানায় রেখেই আমাদের আট দফা দাবি ভূলুণ্ঠিত করা যায়। সেজন্য এক মাসের সময় দেয়া হয়েছে। এখানে নামঞ্জুর হলে আমরা খুশি হতাম। এখানে ন্যায়বিচার আমরা পাই নাই।’ তবে মঙ্গলবার কোনো হামলার ঘটনা না ঘটলেও এর আগে রিগ্যান আচার্য নামে একজন আইনজীবীর ওপর হামলা এবং চেম্বার ভাঙচুর করা হয়েছে বলে জানান তিনি। তার বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে।

এদিকে, সম্মিলিত সনাতনী জোটের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেক মানুষের আইনি সহায়তা পাওয়ার অধিকার আছে।’ জোটের পক্ষ থেকে আইনজীবীদের বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদ জানানো হয়।

সূত্র: বিবিসি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *