পশ্চিমবঙ্গের বিনোদনজগতের বেশ জনপ্রিয় নাম সুদীপা চ্যাটার্জি। “জি বাংলা রান্নাঘর” নামের একটি রান্নার অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করে রান্নার জগতে পেয়েছেন বিশেষ খ্যাতি। আর ওই অনুষ্ঠানকে ঘিরে বাংলাদেশেও বেশ জনপ্রিয় সুদীপা।
আর এই জনপ্রিয়তার কারণেই সম্প্রতি বাংলাদেশে একটি রান্নার অনুষ্ঠান নিয়ে আসা হয় তাকে।
ঈদ উপলক্ষে “রাঁধুনী এপার-ওপারের রান্না” নামের একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অভিনেত্রী তারিন জাহানের সঙ্গে দেখা গেছে সুদীপাকে।
কয়েক পর্বের ওই অনুষ্ঠানের একটি পর্বে তারিন রান্না করেন গরুর মাংসের কোফতা। আর এতেই নেটিজেনদের রোষানলে পড়েছেন সুদীপা চ্যাটার্জি।
“একজন হিন্দু হয়ে গরুর মাংস রান্না হচ্ছে” এমন তথ্য ছড়ানোয় অনবরত হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে সুদীপাকে। এমনকি তার পাঁচ বছরের ছেলেকেও দেওয়া হয়েছে অপহরণের হুমকি।
বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসকে সুদীপা চ্যাটার্জি বলেন, “অনেক মানুষ বিতর্ক জন্ম দিতে ভালোবাসেন। এর আগেও এটা দেখেছি আমি। তবে তারা কেউই সত্যিটাকে জানতে চায় না। কেউই দেখেনি নিজের চোখে। যতজন এই নিয়ে বিদ্বেষমূলক পোস্ট করেছে, তারা জানেই না পুরো ব্যাপারটা। আমি না গরুর মাংস খেয়েছি। না গরুর মাংস রান্না করেছি। আমি গিয়েছিলাম কোরবানির ইদ উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে। তাদের দেশের জাতীয় খাদ্যের মধ্যে পড়ে গরুর মাংস। কারও ধর্মীয় রুচিতে বাধা দেওয়া আমার শিক্ষার মধ্যে নেই। আমি যদি নিজের ধর্মকে সম্মান করি, তাহলে অন্যের ধর্মাচরণে বাধা দিতে পারি না, এটা আমার মত।”
সুদীপা আরও বলেন, আমার সামনে “বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী তারিন জাহান একটি রান্না করেন। উনি প্রথমে বলেন, আজ আমি তোমার জন্য বানাব গরুর মাংস। পর মুহূর্তেই নিজেকে শুধরে নিয়ে বলেন, দর্শকদের রান্না করে দেখাব গরুর মাংসের কোফতা। এটা তারিনের ভুল হয়ে থাকতে পারে। আমি কিন্তু চুপ করে ছিলাম, উত্তর দিইনি।”
তিনি বলেন, “ভিডিওগুলো এখনো অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়েছে। যে কেউ চাইলে দেখে নিতে পারেন। কোথাও দেখতে পাবেন না যে আমি গরুর মাংস স্পর্শ পর্যন্ত করেছি।”
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, “একজন হিন্দু অতিথিকে ডেকে কেন গরুর মাংস রান্না করা হলো। কেন সাবধান হলেন না নির্মাতারা।” এ বিষয়ে তবে সুদীপা হিন্দুস্তান টাইমসে বলেন, “আমি ওই অনুষ্ঠানে ভারতবর্ষকে রিপ্রেজেন্ট করেছি, যেটা আমার কাছে খুব গর্বের। কোনো বিশেষ ধর্মের মানুষ হিসেবে না। ভারত তো হিন্দুদের একার নয়, হিন্দু-মুসলিম সবার। আমরা তো ছোট থেকে এটা শুনেই বড় হয়েছি… মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান। আমারা তো অন্যের ধর্মকে সম্মান করতেই শিখেছি। ক্রিসমাসে চার্চে গিয়ে মোবাতি জ্বালাই, কেক খাই। অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরে গিয়ে মাথায় কাপড় দিয়ে বহু হিন্দু মাথা ঠেকান। তার মানেই তো আমরা সব ধর্মকে সম্মান করি। একটা কুকিং শো-তে গিয়েছি নিজের দেশকে তুলে ধরতে। সেখানে তো হিন্দু মুসলিমের কোনো জায়গাই ছিল না। সে তার ধর্মীয় আচরণ অনুযায়ী গরুর মাংস রান্না করেছে। সে তো আমাকে একবারও বলেনি, খেয়ে দেখুন। সে আমাকে সেই সম্মানটা দিয়েছে।”
এদিকে, বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের অভিনেত্রী তারিন জাহান ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি কলাম লিখেছেন।
তারিন লিখেছেন, “বেশ কিছু দিন ধরে দেখছি সুদীপা চট্টোপাধ্যায়ের গরুর মাংস বিতর্ক নিয়ে উত্তপ্ত ও পার বাংলা। সমাজমাধ্যমে আক্রমণ করা হয়েছে আমাকেও। ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত লাগলে মানুষ অবশ্য নিজের মত দেবেন, এটা স্বাভাবিক।”
এরপর তিনি বলেন, “এ পার বাংলা, ও পার বাংলার নানা পদ নিয়ে রান্নার অনুষ্ঠান ‘রাঁধুনী এপার ওপারের রান্না’। কোন পর্বে, কী পদ রান্না হবে তার চিত্রনাট্যে আগে থেকেই ঠিক করা হয়ে যায়। এই রান্নার অনুষ্ঠানকে ঘিরে যত বিতর্ক। আর আমি এই বিতর্কে না চাইতে জড়িয়ে পড়লাম। মনে হলো নিজের কথাগুলো পরিষ্কার বলি।”
তারিন বলেন, “ঈদের সময় দর্শকের কথা মাথায় রেখে গরুর মাংসের একটি পদ চূড়ান্ত করা হয়েছিল। সেই অনুযায়ী আমরা দর্শকদের জন্য ওই রান্না দেখিয়েছিলাম। আমি কিন্তু ওই অনুষ্ঠানে সুদীপাদিকে গরুর মাংস খেতে বলেছি, বা আমি গরুর মাংস খাওয়াব বলেছি এমন নয়। আমরা খাওয়া তো দূর, ছুঁয়েও দেখিনি। ওই অনুষ্ঠানের ভিডিও যে কেউ দেখতে পারেন “
তিনি বলেন, “ব্যক্তিগত ভাবে আমি প্রত্যেকের ধর্ম, সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধকে সম্মান করি। এ ভাবেই মা-বাবা বড় করেছেন আমায়। বাংলাদেশেও অসাম্প্রদায়িক চেতনার চর্চা হয়। এখানেও হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু মানুষ আছে। দুর্গাপুজো হয়। আমরা মণ্ডপে যাই। ধর্ম নিজস্ব। কিন্তু উৎসব সকলের।”
তারিনের ভাষ্য, “সুদীপাদির গরুর মাংসের বিতর্কের ঘটনা প্রথমে জানতাম না। সমাজমাধ্যমে অনেকে অনেক কিছু লিখেছেন, সেখান থেকেই ঘটনার কথা জানতে পেরেছি। আমি তো টেরই পাইনি ওই দেশে এত কিছু হয়ে গিয়েছে! সুদীপাদি যা বলেছেন সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি আরও একটু বিশদে জানাতে চাই। ওই পর্বের ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, সুদীপাদি যখন আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘তুমি আজ আমাকে কী রান্না করে খাওয়াবে?’ আমি কিন্তু এক বারও বলিনি আমি তোমাকে গরুর মাংসের পদ রান্না করে খাওয়াব! আমি বলেছি ইদ উপলক্ষে দর্শকের জন্য এই পদের রন্ধনপ্রণালী দেখাব। বখরি ইদে আমরা গোমাংসের পদ রান্না করি। কিন্তু একজন অতিথিকে ইদের সময় তো বলতে পারব না, আমি তোমাকে খাওয়াব না! তাই ‘খাওয়াব না’ কথাটা বলিনি ,আবার ‘গরুর মাংস খাওয়াব’ও বলিনি। তা-ও আমাকে ভুল বোঝা হল। সমাজমাধ্যমে লেখা হলো, মানসী সিংহের ছবিতে অভিনয়ের জন্য যখন আমি কলকাতায় যাব, তখন আমাকে শুয়োরের মাংস খাওয়ানো হবে! আমি অবশ্য নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে, মানুষ কোথাও আঘাত পেয়েছে বলে আবেগের বশে এই ধরনের কথা বলে ফেলেছে। কিন্তু এই আঘাত স্বনির্মিত। আর কিছু কিছু মানুষ চরমপন্থীও বটে, ঘটনার আকস্মিকতায় হুট করে কথা বলে দিয়েছে। যে বা যারা বলেছে, তারা তো নিজের দেশকে আরও ছোট করেছে। আমাদের এখানে কেউ এই কথা বলেনি।”
সবশেষে তারিন লিখেছেন, “একটি রান্নার অনুষ্ঠান ঘিরে এত বড় ঘটনা হয়ে গেল। এখন সুদীপাদি কী বলতে চেয়েছেন, কেন ওকে নিয়ে ট্রোল করা হল, কোন কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন তা সম্পূর্ণ ভাবে ওর ব্যক্তিগত বিষয়। আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। অনুষ্ঠান তো দর্শকের জন্যই, আমার আর সুদীপাদির অনুষ্ঠান তো নয়। দুই দেশের মানুষ, দুই দেশের খাবার, রন্ধনপ্রণালী দেখানোর জন্য এই অনুষ্ঠানের আয়োজন। তাতে যেন চিড় না ধরে।”
এদিকে, “রাঁধুনী এপার-ওপারের রান্না” নামের ওই অনুষ্ঠানের আলোচিত পর্বটি এখনো ইউটিউব চ্যানেলে রয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, সুদীপা নিজের হাতে বানান কলকাতার স্টাইল গন্ধরাজ শামি কাবাব। সেখানে তিনি খাসির মাংসই ব্যবহার করেন। পুরো পর্বে একবারও সুদীপাকে কোথাও গরুর মাংসের কোফতা মুখে দিতে বা বা ধরতে দেখা যায়নি।
Leave a Reply