free tracking

আগেভাগে পরিকল্পনা গ্রহণের তাগিদঃ একাধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ, তীব্র লোডশেডিংয়ের শঙ্কা!

বৈচিত্র্যময় আবহাওয়ায় ফাল্গুন মাসেই অনুভূত হচ্ছে তীব্র গরম। কোথাও কোথাও বৈদ্যুতিক পাখার সঙ্গে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রও চালু করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। যা এর আগের বছরগুলোত হয়নি। সামনে আসন্ন রমজান মাস। শুরু হবে সেচ মৌসুমও। এদিকে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন।

এদিকে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে প্রতিদিনই বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে মার্চে বিদ্যুতের চাহিদা গিয়ে পৌঁছাতে পারে ১৮ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত। অর্থের অভাবে জ্বালানি কিনতে না পারায় বন্ধ রয়েছে গ্যাসভিত্তিক অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রও। এমন পরিস্থিতিতে দেশ আবারও তীব্র লোডশেডিংয়ের কবলে পরতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই নগরবাসী দুর্ভোগ কমাতে লোডশেডিং মোকাবিলায় আগেভাগে পরিকল্পনা গ্রহণের কথা বলেছেন।

ভারতের আদানির সঙ্গে মিটমাট হলেও বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র মালিকরা বলছেন, প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা বকেয়া না পেলে জ্বালানির অভাবে উৎপাদন বন্ধ রাখতে হবে তাদের। দেশের অন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে পাবে বিপুল অংকের টাকা। ফলে টাকার অভাবে জ্বালানি কিনতে না পেরে অনেক কেন্দ্রকেই বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রাখতে হতে পারে।

এদিকে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলায় বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। গত মঙ্গলবার দেশের অন্যতম কয়লাভিত্তিক এ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে বন্ধ হয়ে যায় উৎপাদন। এটি উৎপাদনে ফিরতে ৮ থেকে ১০ দিন লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এতে উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎবিভ্রাটের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এমন অবস্থায় অন্যান্য বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছর লোডশেডিংয়ের মাত্রা তীব্র হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে বিদ্যুৎ বিভাগ দাবি করছে বকেয়া পরিশোধে অর্থ বিভাগের আশ্বাস পাওয়া গেছে।

ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, আগামী মার্চ বা ফাল্গুনের শেষে এবং চৈত্রের শুরুতে দেশে গ্রীষ্মকাল শুরু হচ্ছে। একই সঙ্গে একই মাসে শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান। এই সময় বিদ্যুৎ সংকটে লোডশেডিং বাড়বে। ভোগান্তিতে পড়বে সাধারণ মানুষ। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান সরকার বিদ্যুৎ খাতের পরিস্থিতি মোকাবিলার কার্যত অসহায় হয়ে পড়েছে। বিদ্যুতের বকেয়া বিল না পাওযার কারণে উদ্যোক্তরা প্রাথমিক জ্বালানি কিনতে পারছে না। দিন দিন সরকারের কাছে বকেয়া বিলের পরিমাণ বাড়ছেই। গ্যাসের সংকট তীব্র হচ্ছে। এই অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে উচ্চদামের ডিজেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো চালাতে হবে। এতে করে সরকারের ব্যয় ও লোকসান বেড়ে যাবে। এ ছাড়া লোডশেডিং হলে মাঠ পর্যায়ে সেচেও ডিজেল চালিত সেচ পাম্পের খরচও বাড়বে।

চাহিদা ১৮ হাজার মেগাওয়াট ছাড়াতে পারে ॥ বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যমতে, আগামী মার্চে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা হবে ১৮ হাজার ২৩২ মেগাওয়াট। এই চাহিদা মেটাতে গ্যাসিভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে ৬৪০০ মেগাওয়াট, কয়লা থেকে ৫৫৫৮ মেগাওয়াট, ফার্নেস অয়েল- ভিত্তিক কেন্দ্র থেকে ৪১৪৯ মেগাওয়াট এবং ২১২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করতে হবে। এরমধ্যে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর সবই বেসরকারি খাতে। বকেয়া বিল না পাওয়ার কারণে এসব উদ্যোক্ত জ্বালানি আমদানি করতে পারছে না। ফলে গ্রীষ্মে ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলো চালানো নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এছাড়া গ্যাস ও কয়লা সংকটের কারণে প্রক্ষেপণ অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করাও অনিশ্চিত।

দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আছে প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াট। এখন পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে গত বছরের ৩০ এপ্রিল ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ চাহিদার সময় ১৪ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করা হয়েছে গত বছর। বিদ্যুৎ বিক্রি করে প্রতি ইউনিটে গড়ে চার টাকার মতো লোকসান করে পিডিবি। ঘাটতি পূরণে ভর্তুকি দেয় সরকার। পিডিবি বলছে, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ভর্তুকির টাকা ছাড় করলে বকেয়া শোধ করতে পারবে পিডিবি।

বকেয়ার চাপে বিদ্যুৎ বিভাগ ॥ তিন বছর ধরে নিয়মিত বকেয়া অর্থ পরিশোধের চাপে আছে দেশের বিদ্যুৎ খাত। অর্থসংকটে থাকায় বিল দিতে পারছে না পিডিবি। একইসঙ্গে চাহিদামতো ডলার না পাওয়ায় বিদেশী কোম্পানির বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে না। পিডিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গেল নভেম্বর পর্যন্ত পিডিবির বকেয়া ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত গ্যাস বিল বকেয়া জমেছে ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। গ্যাস বিল না দিলে পিডিবিকে গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত রাখতে পারবে না পেট্রোবাংলা। আর ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি পাবে সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো।

বেসরকারি খাতে বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বকেয়া ১০ হাজার কোটি টাকা। আর অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপরীতে বকেয়া ৫/৬ হাজার কোটি টাকা। বকেয়া শোধ না হলে জ্বালানি আমদানি করে উৎপাদন ধরে রাখতে পারবে না এসব কেন্দ্র। এছাড়া ভারতের আদানির কাছে বকেয়া ৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। বর্তমানে চাহিদা কম থাকায় সক্ষমতার অর্ধেক সরবরাহ করছে আদানি। বকেয়া শোধে জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে ১৯ জানুয়ারি পিডিবির কাছে পৌঁছেছে আদানির চিঠি। এ কেন্দ্রের কয়লার বিল নিয়ে বিরোধ আছে। এটি এখনো সুরাহা হয়নি। তারা কয়লার বাড়তি দামে বিল জমা দিলেও পিডিবি বাজার দামে হিসাব করছে।

আমদানি করা বিদ্যুতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সরবরাহ করে ভারতের আদানি পাওয়ার। আদানির বিদ্যুতের ওপর কোন ট্যাক্স-ভ্যাট নেই। তেলের ওপর ১৫ শতাংশের বেশি ট্যাক্স-ভ্যাট রয়েছে। আদানির ট্যাক্স না থাকার পরেও ইউনিট প্রতি দাম পড়ছে ১৭ টাকা ২০ পয়স্।া আর তেলের ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়েও ইউনিট প্রতি খরচ হয় ১৭ টাকা ০৬ পয়সা। তেলের ট্যাক্স বাদ দিলে খরচ আরও কমে আসবে বলে মনে করছে সংশ্রিষ্টরা।

গ্যাস না থাকায় বন্ধ রয়েছে অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ॥ বর্তমানে সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি খাত মিলিয়ে প্রায় ত্রিশটির বেশি ছোট-বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় বন্ধ রয়েছে। পেট্রোবাংলার হিসেব অনুযায়ী বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক আড়াই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। আগামী মার্চে পিডিবি থেকে পেট্রোবাংলার কাছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১৬শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা দেওয়া হয়েছে। তবে পেট্রোবাংলার বলছে, চাহিদার বিপরীতে সর্বোচ্চ ১২শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যাবে।

বকেয়া পরিশোধে অর্থ বিভাগের আশ্বাস পাওয়া গেছে ॥ এতসব সংকটের মধ্যেও আশার আলো দেখছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, গত সোমবার টাকার জন্য আমরা অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছি। আগামী জুন পর্যন্ত অন্তত: ৪ বিলিয়ন টাকা চেয়েছি। অর্থ বিভাগ ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। আশা করছি সংকট থাকবে না।

বকেয়া পরিশোধে সরকার আন্তরিক রয়েছে বলে জানিয়েছেন পিডিবি’র চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিমও। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, বকেয়া পরিশোধ নিয়মিত প্রক্রিয়া। আমরা যে টাকা পরিশোধ করছি না তা না। করছি। কিন্তু যেহেতু দেনার পরিমাণ বেশি তাই এটি একবারে পরিশোধ করা সম্ভব না। অর্থমন্ত্রণালয় অর্থছাড় করলেই আমরা বকেয়া পরিশোধ করছি।

কি বলছেন বেসরকারি উদ্যোক্তারা ॥ বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপ্পা) তথ্যমতে, গত ৬ মাসে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মালিকদের পিডিবির কাছে ১৬ হাজার কোটি টাকা বকেয়া হয়েছে। গরমের মৌসুম শুরুর আগেই বকেয়া পরিশোধ করে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সচল রাখতে হবে। নাহলে বড় ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে। বিপ্পার বর্তমান সভাপতি কে এম রেজাউল হাসনাত জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে বেসরকারি খাতে বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বকেয়া ১০ হাজার কোটি টাকা। আর অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপরীতে বকেয়া ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা।

বিশেষজ্ঞদের আশংকা ॥ সময়মতো বকেয়া পরিশোধ না করলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশংকা করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাও। তারা বলছেন, আসন্ন গ্রীষ্মে বিদুতের চাহিদা মেটাতে এখনি বকেয়া পরিশোধে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম জনকণ্ঠকে বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা দেখছি উৎপাদন সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে সরকারকে হিমশিম খেতে হয়। এর অন্যতম কারণ জ্বালানির সংকট। যেহেতু দেশে পর্যাপ্ত গ্যাসের উৎপাদন নেই সেহেতু আমাদের আমদানির ওপরই নির্ভর করতে হয়। এক্ষেত্রে বাড়তি দাম দিয়ে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। ফলে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে বেশি খরচ হচ্ছে। অন্যদিকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও দীর্ঘদিনের বকেয়ার ফাঁদে পড়েছে। তারাও বলছে গ্রীষ্মে উৎপাদন ব্যহত হতে পারে। তাই এখনি সময় আমাদের গ্রীষ্মের প্রস্তুতি হিসেবে বকেয়া পরিশোধে উদ্যোগী হওয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *