সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা তার দেশত্যাগের কারণ হিসেবে চাঞ্চল্যকর তথ্য জানিয়েছেন। তাকে কীভাবে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল এবং সে সময় কী কী ঘটেছিল তার সঙ্গে সেসব বিষয়ও ফাঁস করেছেন সাবেক এই বিচারপতি।
সম্প্রতি ভিডিও কলের মাধ্যমে বিদেশ থেকে একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় এসব ফাঁস করেন।
এসকে সিনহা জানান, ৭ বছর আগে জোর করে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা তাকে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রেখেছিলেন এবং ডিজিএফআই সদস্যদের মাধ্যমে তাকে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন।
আরও পড়ুনঃ সাবেক বিচারপতি মানিকের ওপর হামলা, গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি!
তিনি বলেন, তার (শেখ হাসিনা) নির্দেশ ও হস্তক্ষেপ উপেক্ষা করে তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন বলেই তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়।
বিচারপতি সিনহা নির্বাহী বিভাগের পরিবর্তে নিম্ন আদালত নিয়ন্ত্রণে বিচারকদের ক্ষমতা সুপ্রিমকোর্টের হাতে রেখে শৃঙ্খলা বিধিমালা প্রণয়নের জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন এবং ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ষোড়শ সংশোধনীর (সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অপসারণ) মামলার রায় সরকারের অনুকূলে দিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছায়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে আমার শেষ দিনগুলো ছিল খুবই ভয়ঙ্কর, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এটা কেবল উপলব্ধি করা যায়।
আমি প্রধান বিচারপতি ছিলাম, তাই আমাকেই গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল। কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি। বাড়ির চারপাশে নিরাপত্তা বাহিনী (গোয়েন্দারা) পাহারা বসায়। আমার একজন স্টাফ বাসায় ঢুকতে গেলে তাকে পেটানো হয়। ডিজিএফআইয়ের তৎকালীন প্রধান সাইফুল আবেদীন মধ্যরাতে আমাকে বিরক্ত করতেন এবং পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার জন্য চাপ দিতেন।
২০১৭ সালের ৩ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ রায় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন। এর ফলে সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের অসদাচরণ তদন্ত ও অপসারণের সুপারিশ করার ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতেই ফিরে আসে।
বিচারপতি সিনহা বলেন, আগের রাতে (২ জুলাই) তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে থাকা আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের (বর্তমানে মৃত) সঙ্গে বৈঠকের জন্য বঙ্গভবনে ডেকে পাঠান।
তিনি বলেন, বৈঠকে শেখ হাসিনা তাকে পরদিন (৩ জুলাই) সরকারের পক্ষে রায় দিতে বললেও তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার স্বার্থে তা প্রত্যাখ্যান করেন।
একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাগবিতণ্ডা চরমে ওঠে এবং আমি তাকে বলেছিলাম যে আমি এখনই পদত্যাগ করব। তখন তিনি আমাকে পদত্যাগ না করার অনুরোধ করেন এবং বলেছিলেন আমি পদত্যাগ করলে জনগণ এটা খুব খারাপভাবে নেবে।
বিচারপতি সিনহা বলেন, ২০১৭ সালের ৩ জুলাই আপিল বিভাগের সাত বিচারপতি ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সর্বসম্মতিক্রমে রায় দেওয়ার পর শেখ হাসিনাসহ ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যরা পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বিষোদগার করেছিলেন। তখন আমি ভেবেছিলাম সরকার হয়তো আমাকে আর দেশে থাকতে দেবে না। আমি এশিয়া প্যাসিফিক দেশগুলোর প্রধান বিচারপতিদের একটি সম্মেলনে যোগ দিতে জাপানে গিয়েছিলাম। কনফারেন্স রুম থেকে বের হওয়ার পর ডিজিএফআই থেকে ফোন আসে এবং আমাকে দেশে ফিরতে নিষেধ করা হয়। একদিন পর আমি সিঙ্গাপুর হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসি। ঢাকায় বিমানবন্দরে নামার পর দেখতে পাই পাঁচ-ছয়জন ডিজিএফআই সদস্য আমাকে ঘিরে রেখেছে। তারা সেখানে উপস্থিত আমার কর্মকর্তাদের কাছে যেতে দিচ্ছিলেন না। একজন লম্বামতো লোক আমাকে বললেন, তারা আমার সঙ্গে এক কাপ কফি খেতে চান এবং আমাকে তাদেরকে পাঁচ মিনিট সময় দিতে বলেন। আমি তাদের ভাষা সংযত করতে বলি এবং প্রোটোকল মানতে বলি। রেগে গিয়ে বলি, ‘গেট লস্ট’। আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অজুহাতে তারা আমার সঙ্গে গাড়িতে উঠতে চেয়েছিল। আমি তাদের বলি যে আমার একটি গাড়ি এবং নিরাপত্তা আছে। আমার তাদের কোনো দরকার নেই এবং চলে যাই। এটা ছিল আরেকটি বাজে সংকেত।
একদিনের ঘটনা বর্ণনা করে তিনি বলেন, আমি আদালতে সুপ্রিমকোর্টে যাই। আমি সবেমাত্র আমার কাজ শেষ করেছি তখনই ডিজিএফআই প্রধান আমার অফিসে আসেন। তিনি আমাকে বলেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই তাকে পাঠিয়েছেন এবং তিনি আমাকে পদত্যাগ করতে এবং দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন। আমি চিৎকার করে বললাম ‘আপনি কে এবং আপনি এসব কী বলছেন’?
‘ডিজিএফআই প্রধান বলেন, তারা শুধু প্রধানমন্ত্রীর আদেশ বাস্তবায়ন করেন, আইনমন্ত্রী বা অ্যাটর্নি জেনারেলের নয়। আমি তাকে বেরিয়ে যেতে বলি। এরপর আমি ঘরে ফিরে গেলে আমাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়’।
এ অবস্থার মধ্যেই ২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর রাতে ঢাকা ত্যাগ করেন বিচারপতি সিনহা।
বিচারপতি সিনহার অনুপস্থিতিতে তৎকালীন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি ওয়াহাব প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
আলাপকালে বিচারপতি সিনহা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে অভিনন্দন জানান।
সাবেক প্রধান বিচারপতি বলেন, তিনি বাংলাদেশে ফিরতে প্রস্তুত। আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে আমি দেশে ফিরব। আমি সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় আছি। সংশ্লিষ্ট আদালতে আত্মসমর্পণ করব এবং প্রমাণ করব যে আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো মিথ্যা।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর বিদেশে থাকা অবস্থায় প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ করা বিচারপতি সিনহা অর্থপাচারের তিনটি মামলায় অভিযুক্ত।
Leave a Reply