বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এতোদিন সরকার বিরোধী আন্দোলন করে আসা দলগুলো এখন নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি। নেতা-কর্মীরা একে বর্ণনা করছেন ‘সুসময়’ হিসেবে। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন।
মামলার ভয় নেই, কর্মসূচিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধা নেই, গ্রেফতার হওয়ার ঝুঁকি নেই। ফলে দলগুলোও এখন নতুন উদ্যোমে রাজনীতির মাঠে নেমেছে।
বিএনপি চেষ্টা করছে, দেশব্যাপী দল গুছিয়ে নির্বাচনের জন্য নেতা-কর্মীদের প্রস্তুত করতে। ইতোমধ্যে স্থায়ী কমিটিতে নতুন মুখ হিসেবে স্থান পেয়েছেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ এবং অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন।
অন্যদিকে জামায়াত চেষ্টা করছে ছাত্র আন্দোলনে আহত-নিহতদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কর্মসূচি দিয়ে ‘জনসম্পৃক্ততা’ বাড়াতে।
তবে একইসঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং নির্বাচন নিয়েও নিজস্ব মতামত আছে দলগুলোর।
এক্ষেত্রে রাষ্ট্র সংস্কার এবং নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ‘যৌক্তিক সময়’ দেওয়ার কথা বলছে।
তবে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পাটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন, অন্তবর্তীকালীন সরকার কতদিনে, কী কী সংস্কার করবে তার একটা রূপরেখা খুব দ্রুতই দেয়া উচিত।
কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের কাছে আসলে কী চায়?
নির্বাচনের জন্য দলকে ‘তৈরি করতে’ চায় বিএনপি
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকার রাজপথে প্রথম বড় ধরনের যে শোডাউন হয়, সেটা করে বিএনপি।
সরকার পতনের একদিন পর নয়াপল্টনে মহাসমাবেশে অংশ নেন দলটির হাজার হাজার নেতা-কর্মী।
তবে এরপরে আর বড় কোন কর্মসূচিতে যায়নি দলটি। বরং অঙ্গ-সংগঠনগুলোর বিভিন্ন অনুষ্ঠান, দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মাজারে নেতা-কর্মীদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো এবং আন্দোলনে আহত-নিহতদের দেখতে যাওয়ার মতো রুটিন কার্যক্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ দেখা গেছে বিএনপির রাজনৈতিক কার্যক্রম।
এরমধ্যে স্থায়ী কমিটিসহ বিভিন্ন কমিটিতে কিছু রদবদল হয়েছে। দলটির কারাবন্দি বহু নেতা কারামুক্ত হয়েছেন এবং হচ্ছেন।
নেতা-কর্মীদের নামে থাকা মামলা কীভাবে প্রত্যাহার হবে সে বিষয়েও প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি।
জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নেতা-কর্মীদের নামে যে মামলা আছে সেগুলোর সমাধান করে সাংগঠনিক দিক দিয়ে একটা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে দলের ভেতরে।
তিনি বলেন,পনেরো বছর ধরে আমরা আন্দোলন করছি। এই আন্দোলনে আটশ নেতা-কর্মী গুম হয়েছে। হাজার হাজার হত্যা হয়েছে। প্রায় ষাট লক্ষ মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হয়েছে। আমাদের চেয়ারপারসনকে মিথ্যা মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছিলো। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এখনও দেশের বাইরে। এই বিষয়গুলোকে এখন আমাদের একটু নরমাল (স্বাভাববিক) অবস্থায় নিয়ে আসতে হবে। সে লক্ষে আমরা কাজ করছি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মামলাগুলো আইনিভাবে মোকাবেলা করেই আমরা তাকে ফেরাতে পারবো বলে আশাবাদী।
তিনি বলেন, আমাদের নিজেদের দলকে আগামী নির্বাচনের জন্য যেন আমরা জনগণের সমর্থন নিতে পারি, সে লক্ষে সংগঠনকে সেভাবে তৈরি করা -এটা এখন আমাদের একটা বড় কাজ। সেটা আমরা শুরু করেছি। ‘গায়েবি মামলাসহ’ যেসব মামলা আছে সেগুলো আইনগতভাবে প্রত্যাহারে আলাদা দল করে দেয়া হয়েছে। তারা কাজ করছে।
তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের দাবি থেকে সরে আসার কারণ
বিএনপির পক্ষ থেকে শুরুতে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের দাবি করা হলেও এখন আর নির্দিষ্ট কোন সময়সীমার কথা বলছে না দলটি। বরং অন্তর্বর্তী সরকারের করণীয় কী হবে সে বিষয়ে বক্তব্য তুলে ধরা হচ্ছে দলটির পক্ষ থেকে।
এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় সামনে আনছে বিএনপি।
এক. নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন।
দুই. প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর সংস্কার।
তিন. সাবেক সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
চার. অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনা।
বিএনপি বলছে, এসব বিষয়ে সরকারকে দ্রুত কাজ করতে হবে।
এনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলছেন, আমরা প্রথমে বলেছিলাম তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন। কিন্তু পরে যখন আমরা বাস্তবতা লক্ষ্য করেছি যে তিন মাসে সম্ভব নয়। তাদেরকে অবশ্যই কিছু সময় দেওয়া দরকার। এখানে আমরা কোন সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার কথা বলছি না। একটা যৌক্তিক সময় অবশ্যই তাদের দিতে হবে এসব কাজ করার জন্য।
অন্তবর্তীকালীন সরকারকে ‘যৌক্তিক সময়’ দিয়ে এই সময়ের মধ্যে দলের পুনর্গঠন, মামলা প্রত্যাহার এবং বিশেষত: দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফিরে আসার পথ পরিষ্কার করতে চায় বিএনপি।
নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কী করছে জামায়াত?
বিএনপি বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে সক্রিয় আছে। কিন্তু আরেকটি বড় দল জামায়াত পুরোপুরি নজর দিয়েছে তাদের ভাষায় জনসংযোগের উপর। রাজপথে বিক্ষোভ বা সমাবেশের মতো কোন কর্মসূচি আপাতত নেই জামায়াতের।
দলটির কার্যক্রমে এখন তিন ধরনের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে।
এক. ছাত্র আন্দোলনে আহত-নিহতদের আর্থিক সহায়তা। প্রতিদিনই দলটির নেতারা কোন না কোন হাসপাতালে গিয়ে আহতদের খোঁজ-খবর এবং আর্থিক সহায়তা করছেন। এছাড়া নিহতদের পরিবারের কাছে গিয়ে সমবেদনা জানাচ্ছেন।
দুই. সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মন্দির পরিদর্শন এবং তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করা হচ্ছে।
তিন. এর আগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনে সক্রিয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময়।
দলটির জন্য অবশ্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বৈঠক থেকে শুরু করে প্রকাশ্যে এ ধরনের সাংগঠনিক কার্যক্রম গত ১৬ বছরের প্রেক্ষাপটে নতুন অভিজ্ঞতা।
যদিও কাগজে-কলমে দলটি এখনও রাজনীতিতে নিষিদ্ধ।
জামায়াত এখন চেষ্টা করছে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের। কিন্তু সেটা কীভাবে হবে?
জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেন, নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তারা বিচলিত নন। বরং নির্বাহী আদেশেই নিষেধাজ্ঞার প্রত্যাহার চান তারা। এর জন্য তারা আদালতে যাবেন না।
শফিকুর রহমান বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ছিল অবৈধ সরকার। সুতরাং অবৈধ সরকারের কোন ডিক্লারেশন আমরা মানি না। তারপরও তারা তো নিষিদ্ধ করে গেছে। এখন সেই অবৈধ সরকার যেটা করে গেছে সেটা নির্বাহী আদেশের ব্যাপার। তাদের সকল ‘অবৈধ নির্বাহী আদেশ’ বাতিল করে দেয়া উচিত বলে মনে করি আমরা। আমাদেরকে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সুতরাং এটার প্রত্যাহারও নির্বাহী আদেশেই হতে হবে। আমরা এর জন্য আদালতে যাবো কেন? আদালতের মাধ্যমে তো আমাদেরকে নিষিদ্ধ করা হয়নি।
কিন্তু জামায়াত যে নির্বাহী আদেশ বাতিল চায় সেটা কি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে জানানো হয়েছে? এমন প্রশ্নে জামায়াত আমির জানান, সেটা সরকারকে বলা হয়েছে।
কিন্তু জবাবে সরকারের পক্ষ থেকে কী বলা হয়েছে এমন প্রশ্নে আমিরে জামায়াত বিস্তারিত কিছু বলতে চাননি। তবে তিনি বলেন- আমরা এখন তাদের অ্যাকশন দেখতে চাচ্ছি। তারা যেটাই বলুন, আমরা অ্যাকশন (কাজ) দেখতে চাচ্ছি।
জামায়াতের এই শীর্ষ নেতা বলেন, সরকার পতন আন্দোলনে জামায়াত ‘পূর্ণশক্তি’ নিয়েই অংশ নিয়েছিলো। সুতরাং ‘ন্যায্যতার ভিত্তিতে’ সরকার জামায়াতের ‘পাওনা’ সরকার খুব তাড়াতাড়ি মিটিয়ে দেবে বলে আশা তার।
মামলার বিচার এবং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ নিয়ে যা বলছে জামায়াত
বিএনপির মতো জামায়াতও চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেন প্রশাসন, বিচারবিভাগ এবং অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতের প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত এগিয়ে নেয়। একইসঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার উপরও জোর দিচ্ছে জামায়াত। বলছে নির্বাচন কমিশন সংস্কার করে পুনর্গঠনের কথা।
এছাড়া আন্দোলনে নিহতের ঘটনায় আইনি বিচারের উপরও গুরুত্ব দিচ্ছে দলটি।
‘যারা ব্যক্তগিতভাবে অপরাধ করেছে তাদের বিচার অবশ্যই হতে হবে। তারা অপরাধী হলে অবশ্যই শাস্তি পাওয়া উচিত। এটা হচ্ছে ব্যক্তির বিচারের ক্ষেত্রে। আর দল হিসেবে পুরো দলটাই হত্যায় শরিক হয়ে গিয়েছিলো।’
‘তাদের মন্ত্রী বলেছেন, ছাত্রদের আন্দোলন দমনের জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট। তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়ালো? একটা দল পুরো দায়িত্ব নিয়ে নিলো সন্ত্রাস করার এবং সেটিই হলো। অনেক প্রাণ ঝরে গেলো। সন্ত্রাসীদেরকে যখন বাহিনী হিসেবে দলীয় ব্যানারে নামিয়ে দেয়া হল তখন বিশ্বের বহু দেশে এমন নজীর আছে যে, এমন গণহত্যা যারা করে… তাদের আর সেদেশে রাজনীতি করার অধিকার থাকে না।’
তবে জামায়াতের আমির জানাচ্ছেন, তারা এখনও দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি জানাননি। এ বিষয়ে দলে কোন সিদ্ধান্তও হয়নি বলে নিশ্চিত করেন শফিকুর রহমান।
সংস্কারের রোডম্যাপ চান গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অতীতের আন্দোলনে বিএনপির নেতৃত্বে বিভিন্ন দল এবং জোট যুগপৎ আন্দোলন করেছে। এসব আন্দোলনে বিভিন্ন সময় রাষ্ট্র সংস্কারের নানা রূপরেখা দেয়া হয়েছে দলগুলোর পক্ষ থেকে।
আওয়ামী লীগের পতনের পর এখন যখন সংস্কারের সুযোগ এসেছে তখন এসব দলগুলোর মধ্যে বড় দুটি দল বিএনপি ও জামায়াত তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। তারা চায়, সংস্কারের কাজে ‘যৌক্তিক সময়’ নিক ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
তবে অতীতে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা এবং বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক অবশ্য বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সফল হতে হলে সবার আগে তারা কী কী সংস্কারে হাত দেবে, সেটার রূপরেখা দরকার।
তিনি বলেন,‘এখানে একটা আস্থার সম্পর্ক দরকার। সেটা আছে। কিন্তু সরকার কোন কাজগুলোতে প্রাথমিকভাবে হাত দেবে, কতদিন সময় লাগতে পারে, কী কী করবে সেসব বিষয়ে তাদের জনগণকে পরিষ্কার ধারণা দেয়া উচিত। এ বিষয়ে আলোচনার ভিত্তিতে তারা যদি একটা রোডম্যাপ দিয়ে দেয় তাহলে দলগুলোর মধ্যে কোন প্রশ্ন বা অনিশ্চয়তা থাকবে না। কারণ সব দলই চায় সংস্কার এবং একইসঙ্গে নিরপেক্ষ নির্বাচন।’
‘আমরা আগামী আরও এক/দুই মাস হয়ত দেখবো। আমরা চাই এরমধ্যে সবার সঙ্গে আলোচনা করে সরকার একটা রোডম্যাপ তৈরি করুক। ইনডিফিনিট পিরিয়ডে রোডম্যাপ ছাড়া যদি চলতে যাই, তাহলে প্রশ্ন উঠবে যে সরকারের ঘোষিত অ্যাজেন্ডার বাইরে অঘোষিত কোন অ্যাজেন্ডা আছে কি-না।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলছেন, রাষ্ট্র সংস্কারের পর যে নির্বাচন হবে সেখানে তারা অংশ নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
তবে তার দল নির্বাচনে বিএনপি বা অন্য দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করবে নাকি এককভাবে করবে এমন প্রশ্নে সাইফুল হক জানিয়েছেন, সে বিষয়ে কোন দলের সঙ্গে আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি। সেটা হবে পরবর্তীকালে, পরিস্থিতির আলোকে।
Leave a Reply