ছাত্র-জনতার বৈপ্লবিক গণঅভ্যুত্থানে যে নতুন বিজয়ের স্বাদ বাঙালি জাতি পেয়েছে। সে স্বাদ মাস পেরুতে না পেরুতেই বিষাদে রুপ নিচ্ছে। ৫ আগস্ট দিনটি বাঙালি জীবনের এক অন্যান্য দিন। ছাত্র-জনতার যে জোরালো বাঁধন আমরা সেদিন দেখতে পেয়েছি, সে বাঁধনের জন্ম কিন্তু ২০২৪ এ হয়নি, হয়েছে ২০১৮ তে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের যে বিরাট ভূমিকা ছিলো, সে ভূমিকাকে আবারও দেখা মেলে আঠারোর কোটাবিরোধী আন্দোলনে এবং নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে। শেষমেশ ভূমিকা এসে পূর্ণতা পায় এবার, যার স্বাদ আমরা পেলাম গেল আগস্ট মাসের ৫ তারিখে। যুগে যুগে দেশ, জাতি, সমাজের যতো পরিবর্তন হয়েছে সবকিছুর মূলে ছিলো তারুণ্য। আর এই তারুণ্যকে ধারণ করতে পারে একমাত্র শিক্ষার্থী কিংবা ছাত্ররা। তারুণ্য আমার কাছে এক অস্ত্রের নাম, এ অস্ত্র এতটাই শক্তিশালী যে কিনা দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বৈরাচারীতাকে নিমিষেই গুড়িয়ে দিতে পারে।
ইতিহাস বদলে দেয়া এ তারুণ্য যখন সকল অবদানের অংশীদার তখন এ তারুণ্যের দল কেন রাজনীতিতে আসবেন, কেন দেশ চালাতে আসবেন। এসব বিষয় নিয়ে দেশের ঝানু রাজনৈতিক দলগুলো ভেবে ভেবে মরছে।
ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রনেতারা বিজয় পরবর্তী সময়ে যখন রাজনৈতিক দলগুলোর ভুলগুলোকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় সে সময় নানামুখী খাপছাড়া কথা বলে মুখে ফ্যানা তুলতেও দেখা যাচ্ছে তাদের।
ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের শুরু এইতো ক’মাস আগে। শুরুতে দাবি ছিলো এক দফা, যা ছিলো কোটার যৌক্তিক সংস্কার, তারপর এলো নয় দফা। সবশেষ, নয় দফাকে রক্ত মাখিয়ে বিগত ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার এক দফায় ডায়বার্ট করলো। এক দফা ছিলো সরকারের পদত্যাগ। সেখান থেকেই ছাত্রদের সঙ্গে বাঁধন বেঁধে এক হয়েছিলো বাংলাদেশের মুক্তিকামী সর্বস্তরের মানুষ। ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ নামের কর্মসূচিই বিদায় ঘণ্টা বাজিয়েছিল হাসিনা সরকারের।
এই যে এমন এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আমরা দেখলাম। এর পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর কতটা অবদান? তা কি ঠাহর করতে পারবেন? ঠাহর যদি করতেই হয় তাহলে চলুন একটু পেছনে ফিরে যাই। গেল বছরের ২৮ অক্টোবর দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি যে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মাঠে নেমে হাসিনা সরকারকে ফেলে দেয়ার স্বপ্ন দেখায়, সে স্বপ্ন দেখে বাঙালির কপাল যেন আবারও পুড়েছিলো সেদিন। খুব আশা নিয়ে বিএনপির অ্যাকশান দেখার জন্য ২৮ অক্টোবর যখন টিভিতে চোখ রাখি তখন দেখতে পাই, নয়াপল্টনের বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশে পুলিশের কয়েকটা ফাঁকা গুলির আওয়াজে মুহুর্তেই স্টেজসহ এমনকি পুরো নয়াপল্টন লোকশূণ্য হয়ে পড়ে।
সেদিনটির পর বিএনপি নামক দলের প্রতি জনমানুষের যে এক আস্থা ছিলো, সেটিও দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে যায়। শুধু তাই নয় বিএনপি এক জোকার দলে পরিণত হয়ে যায়। কারণ তারা কোন কর্মসূচি দিলে মানুষ শুনে দুঃখের হাসি হাসে। জনগণ বুঝে যায় যে এদের দ্বারা কোন কিছুই সম্ভব নয়।
রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির কাছে মানুষের অনেক চাওয়া-পাওয়া আছে। সে জায়গা থেকে বিএনপির যেমন ভূমিকা রাখা প্রয়োজন ছিলো, তা কিন্তু মানুষ তেমন দেখতে পায়নি। আওয়ামী লীগ যে এক নির্মমতার জন্ম দিয়েছে, নিশ্চয়ই বিএনপি এদের মতো নয়। মুক্তিকামী বাঙালির হয়ে বিএনপিও রাজপথে থেকেছে, কাজ করেছে এসব অস্বীকার করারও সুযোগ নেই।
আমাদের লাল সবুজের এ বাংলাদেশের ইতিহাস দীর্ঘ ৫৪ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস। এ দীর্ঘ পথচলায় ৩টি রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার হাত বদল আমরা দেখে এসেছি। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি। আশা, ভরসা, সুখ-শান্তির আশ্বাস একের পর এক ক্ষমতার পালাবদলে দেশের মূল তথা জনগণ দিনশেষে তেমন কিছুই তাদের পক্ষ থেকে পায়নি। পূর্ণতার স্বপ্ন দেখিয়ে প্রত্যেকেই কিছু না কিছু অপূর্ণ রেখে গেছেন।
দেশের মানুষ যখন ঘুরে-ফিরে এদেরকেই তাদের নিয়ন্ত্রক হিসেবে দেখতে পান তখন তারা খুব করে আশাহত হয়ে পড়েন। আমাদের দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ একটু ভালো থাকতে চান, ভালো খেতে চান এইটুকুই তো। কিন্তু এ ৩ দলের পালাবদলে মানুষ মোটা দাগে মন্দ থেকেছেন এটাই যেন ইতিহাস বড় গলায় বলে।
প্রতিটি নির্বাচনে মানুষ চায় নতুন কিছু আসুক, পরিবর্তন হোক। কিন্তু তাদের এ চিন্তা-চেতনা গত ১৫/১৬ বছর বন্দিশালায় ছিলো। কেননা তারা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে ছাড়া অন্য কোনটিকে ভাবতেই পারতেন না। কারণ আওয়ামী লীগ সরকার গায়ের জোরে, বিনা ভোটে, চুরির করে বার বার ক্ষমতায় এসেছে। নির্বাচন এলে এমনটা হয় বা হবে এটা যেন ১৫/১৬ বছর একটা নিত্য রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছিলো প্রতিটি মানুষের মধ্যে।
এসব কথা থাক। মূল জায়গায় আসি। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ তো বিনাশ হলো। কিন্তু বিএনপির কর্মকাণ্ডগুলো আমাকে খুব গভীরভাবে আঘাত করেছে। এ কথা বলছি এ কারণেই, আওয়ামী লীগ যেদিন থেকে নুয়ে পড়লো ঠিক সেদিন থেকে বিএনপি যেন আওয়ামী লীগ রুপে বিস্তার করা শুরু করলো। আমার পরিচিত অনেক বিএনপি নেতা-কর্মী চাঁদাবাজি, লুটতরাজ ইত্যাদি অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয় এমন ঘটনা সারাদেশে প্রতিদিন চোখে পড়ছেই।
এসবের আগে সাধারণ মানুষ ভেবেছিলো বিএনপি হয়তো কোন পার্থক্য সৃষ্টি করবে কিন্তু কোথায় তাদের পার্থক্য? লুটেপুটে খাওয়া, মেরে-ধরে খাওয়ার যে সংস্কৃতির চেয়ার ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ তৈরি করে গেছে ঠিক সে চেয়ারেই বিএনপি বসে পড়েছে। এমনটাই দেখে চলছি নিত্যদিন। অথচ পার্থক্য কিংবা ভিন্নতা যদি থাকতো তবে কি এসব দেখতো হতো আমাদের? নিশ্চয়ই না।
এখনও যখন সোস্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখি তখন দেখি বিএনপিকে মানুষ তুচ্ছ চোখে দেখে। এর মাধ্যমে মানুষ এটাই জানান দিতে চায় যে তারা বিএনপিকেও চায় না, পরিবর্তন চায়, নতুন কিছু চায়। আমি মনে করি মানুষের চাওয়া, আশা আকাঙ্খার উর্ধ্বে কেউ নয়।
আওয়ামী লীগ, বিএনপির পরিবারতন্ত্র রাজনীতি এ দেশের মানুষ আর চায় না। তারা বুঝে এবং জেনে গেছে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি এরা একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। সুতরাং এদের হাত থেকে দেশ এবং দেশের মানুষকে নতুন আশার প্রদীপ দেখাতে পারে ছাত্রদের গঠিত রাজনৈতিক দল। এ দল গঠন অতি জরুরি। মানুষ চায় গণতন্ত্র, জনতন্ত্র। কিন্তু বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগের ইতিহাসে গণতন্ত্র কিংবা জনতন্ত্রের স্বাদ এদেশের মানুষ নিশ্চয়ই পায়নি।
পাহাড় সমান শক্তিশালী ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে যেহেতু ছাত্রদের সংগ্রাম রুখে দিয়েছে সেহেতু একমাত্র তারাই পারবে বাংলাদেশকে প্রকৃত সোনার বাংলা উপহার দিতে। বার বার হোচট খাওয়া এ দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখে নতুন এ বাংলাদেশ নতুনদের হাত ধরেই আগামীর ইতিহাস রচিত করবে। এবং এটাই হোক, এটাই হওয়া চাই।
লেখক: তরুণ কবি ও সাংবাদিক।
Leave a Reply