ভারতের অন্যতম শীর্ষ ধনী রতন টাটা মারা গেছেন। স্থানীয় সময় বুধবার (৯ অক্টোবর) রাতে ভারতের মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে না ফেরার দেশে চলে যান তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হল দেশের শিল্পক্ষেত্রের একটি অধ্যায়। নিজের আয়ের ৬৫ শতাংশ মানুষের কল্যাণে দান করে যাওয়া রতন টাটার মৃত্যুতে ভারতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। দেশটির রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী ও শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গনের শীর্ষ স্থানীয়রা শোক প্রকাশ করে বার্তা দিয়েছেন।
রতন টাটাকে চেনেন না পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। জীবনে তিনি শুধুমাত্র একজন সফল শিল্প উদ্যোক্তাই ছিলেন না। ছিলেন মানবতার ফেরিওয়ালা। মানব সেবায় তার বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে ভারতে। রতন টাটার ব্যক্তিত্ব, মানবিকতা আর পাঁচজন ব্যবসায়ীর থেকে উঁচু স্থানে পৌঁছে দিয়েছে তাকে। একজন সফল ও বিশ্বের প্রথম সারির ব্যবসায়ী হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ তাকে মানুষ হিসেবেই দেখেছে। এই মানুষটির ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও আগ্রহ বহু মানুষের।
টাটা গ্রুপের ব্র্যান্ডিংয়ে সবচেয়ে বড় অবদান রতন টাটার। অর্ধশত বছর ধরে তিনি নিরলস পরিশ্রম করেছেন টাটা গ্রুপের জন্য, তিলে তিলে বড় করেছেন গ্রুপকে। এই অনন্য প্রতিষ্ঠানটির ২১ বছর ধরে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন রতন টাটা। এ সময়ে টাটা গ্রুপের আয় বেড়েছে ৪০ গুণ। আর মুনাফা বেড়েছে ৫০ গুণ। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে টাটা গ্রুপের দায়িত্ব পালন করে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিলেও ব্যক্তি জীবনে বিয়ে করা হয়ে উঠেনি রতন টাটার।
মজার ব্যাপার হলো, চার বার এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তাঁর প্রায় বিয়ে হয়েই যাচ্ছিল। কিন্তু নানা কারণে বিয়ে করতে পারেননি। তিনি একবার বলেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে কাজ করার সময়ে তিনি প্রেমে পড়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধের কারণে মেয়েটির বাবা-মা তাঁকে ভারতে পাঠানোর বিরোধিতা করেন। এরপর আর বিয়ে করেননি তিনি।
ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খুব একটা কথা বলতেন না রতন টাটা। তবে বেশ কয়েক বছর আগে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের সঙ্গে খানিকটা মন খুলে কথা বলেছিলেন তিনি। রতন টাটা বলেছিলেন, প্রেম করলেও বিয়ে করার সাহস আর পাননি। কোনো না কোনো কারণ দেখিয়ে পিছু হটেছেন। প্রথম প্রেমিকা ছিলেন এক মার্কিন তরুণী। যুক্তরাষ্ট্রে তখন কাজ করতেন তিনি। প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যেও তার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়। কিন্তু তাকে বিয়ে করতে পারেননি।
২০১১ সালে একটি সাক্ষাৎকারে রতন টাটা বলেছিলেন, তার জীবনে চার বার বিয়ের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নানা কারণে পিছিয়ে আসতে হয় তাকে। একাধিক সম্পর্কে জড়ালেও শেষ পর্যন্ত বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি রতন টাটা। তাই শেষদিন পর্যন্ত কুমার থেকে গেলেন। অনেকে মনে করেন ছোটবেলা বাবা-মায়ের বিচ্ছেদই রতন টাটার মধ্যে বিয়ের ভীতি তৈরি করেছে। ১৯৩৭ সালে মুম্বাইয়ে রতন টাটার জন্ম। রতন টাটার বাবা নাভাল টাটা পরিবারে এসেছিলেন দত্তক সন্তান হিসেবে। রতন টাটার বয়স যখন ১০ বছর, তখন মা-বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। সেই সময় থেকেই ঠাকুরমা নভাজিবাই টাটা তার দেখাশোনা করেন।
মুম্বাইয়ের ক্যাম্পিয়ন স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় রতন টাটার। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই পড়াশোনা করেন। এরপর তাকে ভর্তি করানো হয় মুম্বাইয়ের ক্যাথিড্রাল অ্যান্ড জন কনন স্কুলে। পরে তিনি শিমলার বিশপ কটন স্কুল এবং আমেরিকার নিউইয়র্কের রিভারডেল কান্ট্রি স্কুলেও পাঠ নেন। ১৯৫৫ সালে রতন গ্র্যাজুয়েট হন একই প্রতিষ্ঠান থেকে। ১৯৫৯-এ কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে রতন টাটা যে এক আশ্চর্য মানুষ ছিলেন, তা সর্বজনবিদিত। দানের ব্যাপারে নামডাক ছিল রতন টাটার। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ হাজার ২৯ হাজার ৭৩৪ কোটি রুপি দান করেছেন তিনি। কেবল মহামারিকালেই বিভিন্ন খাতে বিলিয়েছেন ১ হাজার ৫০০ কোটি রুপি।
রতন টাটার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজের এক্স মাধ্যমে রতন টাটার সঙ্গে ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, রতন টাটা একজন দূরদর্শী মানুষ ছিলেন। একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন। তাঁর নম্রতা এবং আমাদের সমাজের উন্নতিতে তাঁর ভূমিকার জন্য রতন টাটাকে মনে রাখবে সবাই।
সূত্র: হিন্দুস্তান টাইমস
Leave a Reply