ডিম কেনারও সামর্থ্য নেই জাকিরের, মেহেরুন্নেছার চোখে জল!

শুক্রবারের সকাল। খুলনা নগরীর মিস্ত্রিপাড়া কাঁচাবাজার। ফুলবানু ও সালমা আক্তার নামে দুই নারী ঘণ্টাখানেক ধরে বাজারে ঘুরছেন। হাতের ব্যাগ তখনও ফাঁকা। দীর্ঘক্ষণ ঘোরার কারণ জানতে চাইলে একরাশ ক্ষোভ তাদের কণ্ঠে। জানালেন চড়া দামের সঙ্গে প্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য আনা টাকার হিসাব মেলাতে পারছেন না। তাই ঘুরে ঘুরে দরদাম করছেন।

ফুলবানু ও সালমা সম্পর্কে ননদ-ভাবী। একই ছাদের নিচে দুই পরিবারের ৯ সদস্য বসবাস করেন। তিনজন কর্মক্ষম ব্যক্তি রয়েছেন তাদের সংসারে। যদিও দিনমজুরের কাজ করায় এবং বিভিন্ন সময় কাজ না থাকায় তাদের কারও আয় উল্লেখযোগ্য নয়। এ দুই নারীর দাবি, বাজার ক্রমাগত পিছিয়ে দিচ্ছে তাদের জীবন।

একই বাজারে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কথা হয় বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত বিশ্বজিৎ রায় নামে এক চাকরিজীবীর সঙ্গে। তার মাসিক আয় সব মিলে ২০ হাজার টাকার মতো। কথায় কথায় তিনি জানান, খুব সকালে আরও একবার এসেছিলেন বাজারে। তবে দাম অতিরিক্ত হওয়ায় খালি হাতেই ফিরে গেছেন বাসায়। দুপুরে আবার এসেছেন যদি দাম কিছুটা কমে। তবে চিত্র খুব একটা বদলায়নি বলে দাবি তার। টেংরা মাছ ৮০০ টাকা কেজি, পারশে ৬০০ টাকা আর হরিণে চিংড়ি ৭০০ টাকা হওয়ায় না কিনে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।

এই বাজারে আখের রস বিক্রি করেন জাকির মোক্তার নামের পঞ্চাশোর্ধ এক ব্যক্তি।

তিনি বলেন, ‘বাজারে ৭০-৮০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই। সারাদিনে বড়জোর ৫শ’ টাকা আয় হয়। ৪ সদস্যের পরিবারে ঘর ভাড়া, ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ দিয়ে দুই বেলা খেলে একবেলা অভুক্ত থাকতে হয় তাদের। অন্তত ডিমের দামও যদি নাগালে থাকত, তাহলে ছেলে-মেয়েদের খাওয়াতে পারতাম।’ ৫৫ টাকা দিয়ে এক হালি ডিম কেনা কষ্টসাধ্য বলে জানান তিনি।

বাজারটি ঘুরতে ঘুরতে এক কোণায় দৃষ্টি পড়ে ষাটোর্ধ্ব এক নারীর দিকে। নাম মেহেরুন্নেছা। জীর্ণ শরীরে ধুনিয়াপাতা, কচুরমুখি, কয়েকটি পেঁপে ও একটি কলার মোচা বিক্রি করতে বসেছেন তিনি। বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন মাত্র ১১০ টাকা।

কথা বলার এক পর্যায়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি জানান, ৫০০টাকা দিয়ে এসব সবজি কিনে এনেছেন। পুঁজি কম থাকায় ভালো জিনিস কিনতে পারেননি। এখন বিক্রিও হচ্ছে না। সব বিক্রি করতে পারলে পরের দিনের পুঁজি রেখে রাতের জন্য ছোট একটি লাউ কেনার ইচ্ছা তার।

নগরীর রিকশাচালক মো. মামুন। এদিন দুপুরে ভাত না খেয়ে এক প্যাকেট দশ টাকার বিস্কুট আর এক গ্লাস পানি দিয়ে ক্ষুধা মেটানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি। নিকটবর্তী হোটেলে ভাত কেন খাচ্ছেন না এমন প্রশ্ন ছিল তার কাছে। তিনি বলেন, একটি ডিম দিয়ে ভাত খেতে হলেও ৫০ টাকা প্রয়োজন। তার সারাদিনের আয় সর্বোচ্চ ৬শ’ টাকা। বাড়ি চারজন রয়েছে। খরচ কমাতে তাই দুপুরে বিস্কুট বেছে নিয়েছেন তিনি।

উপরে উল্লেখিত ব্যক্তিদের গল্প, জীবিকার মাধ্যম, দৈনন্দিন ব্যয় সবকিছু ভিন্ন হলেও একটি জায়গায় তাদের মতামত অভিন্ন। সবার দাবি, গত কয়েক বছরের মতো এখনও বাজার ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে তাদের থেকে। সরকার পরিবর্তন হলেও পণ্যের দাম সেই আকাশছোঁয়া। ধরতে গেলে পুড়ে যাচ্ছে হাত। সংকট থাকলেও দাম বৃদ্ধির জন্য সিন্ডিকেটকে দায়ী করে নতুন সরকারকে কঠোরভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণের দাবি জানিয়েছেন তারা।

এদিন বাজার ঘুরে দাম সম্পর্কে জানা যায়, প্রতিকেজি ঢেড়শ ৭০ টাকা, পটল ৮০ টাকা, মিষ্টিকুমড়া ৮০ টাকা, উচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা, বেগুন ১২০ টাকা, পাতাকপি ৮০ টাকা, ফুলকপি ২০০ টাকা, লাল শাক ৮০ টাকা, লাউ ৫০ থেকে ৮০ টাকা, শশা ৬০-৭০ টাকা, কচুরমুখি ৭০-৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে মরিচের দাম কিছুটা কমেছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, অতিরিক্ত দামের কারণে বাজারে ক্রেতাও কমেছে বেশ। দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেন টানা বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা, কয়েকটি জেলায় বন্যায় অনেক সবজির বাগান নষ্ট হয়ে গেছে। তাই সবজির দরও বাড়তির দিকে। উৎপাদন কমে যাওয়াই এর প্রধান কারণ। মাসখানেকের মধ্যে শীতকালীন সবজি ওঠা শুরু হলে দাম কিছুটা কমবে বলে আশা ব্যবসায়ীদের।

অপরদিকে মাছ বিক্রি হচ্ছে রুই ২৬০ থেকে ২৮০টাকা, কাতলা ২০০টাকা, পারশে ৫০০ থেকে ৬০০টাকা, কৈ ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা, টেংরা ৬০০ থেকে ৮০০টাকা, চিংড়ি ৫০০ থেকে ৭০০টাকা, তেলাপিয়া ১২০টাকা, পাঙাশ ১৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

মাছ ব্যবসায়ীরা বলছেন, মা ইলিশ রক্ষায় সমুদ্রে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা থাকায় বাজারে মাছের সরবরাহ কমেছে। এছাড়া ঘূর্ণিঝড়সহ কয়েকটি কারণে কয়েক দফায় মানুষের মৎস্য ঘের-পুকুর ভেসে গেছে। মাছ মরেও উৎপাদন কমেছে। ফলে সরবরাহ কমায় দাম বেড়েছে। সাগরে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে এবং ঘেরের মাছ চাহিদা অনুযায়ী বাজারে আসলে দাম কমতে পারে মনে করেন তারা।

এদিকে খুলনায় দর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাজার সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধিনে গঠিত মনিটরিং টাস্কফোর্স দল কাজ করছে বলে জানিয়েছেন টাস্কফোর্স কমিটির আহবায়ক ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মীর আলিফ রেজা।

তিনি জানান, জেলা প্রশাসন, ভোক্তা অধিদপ্তর, জেলা ও মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং ছাত্র প্রতিনিধিদের নিয়ে ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করা হয়েছে। অভিযানের মাধ্যমে মাছের বাজার, কাঁচাবাজার ও বিভিন্ন মুদি দোকানে পণ্যের দাম যাচাই করা হচ্ছে। কোথাও অসঙ্গতি বা অনিয়ম পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও উল্লেখ করেন তিনি।

তবে দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য বাজার ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানো জরুরি বলে মনে করছেন নাগরিক নেতা ও অর্থনীতিবিদরা।

খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব মো. বাবুল হাওলাদার বলেন, বাজার তদারকি সংস্থাগুলো নামমাত্র অভিযান পরিচালনা করে। যাতে ক্রেতার বাস্তবিক অর্থে কোনো লাভ হয় না। সমস্যা সমাধানে নতুন বছরের আগেই বাজার ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের তালিকাভুক্ত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে, যোগ করেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *