রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের গরুর হাটে এরইমধ্যে প্রচুর কোরবানির পশু উঠেছে। ছোট মাঝারি আকারের গরুর চাহিদা বেশি, সেইসঙ্গে দামও বেশি হাঁকানোর অভিযোগ করছেন ক্রেতারা। অন্যদিকে গো-খাদ্যের দাম বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে গরুর দাম বেড়ে গেলেও, ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না বলে দাবি বিক্রেতাদের।
বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) থেকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের হাটগুলোতে ঈদুল আজহা উপলক্ষে পুরোদমে পশু বেচাকেনা শুরু হয়েছে। দেশে কোরবানিতে পশুর চাহিদা আছে ১ কোটি ৭ লাখ, কিন্তু কোরবানির জন্য প্রস্তুত আছে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ পশু; যা চাহিদা অনুযায়ী অনেক বেশি বলে রোববার (৯ জুন) এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান। মন্ত্রীর কথা অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত দেশের হাটগুলোতে পর্যাপ্ত গরুর দেখা মিললেও, দাম নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
ঢাকায় ২০টি হাট থেকে পশু কিনতে পারছেন ক্রেতারা। এরমধ্যে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে ১১টি হাট বসেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায়। আর উত্তর সিটিতে বসেছে ৯টি। এছাড়া রাজশাহীতে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ২৫ টি কোরবানির পশুর হাট বসেছে। খুলনা জেলায় এ বছর ১০টিরও বেশি নিয়মিত পশুর হাটের সঙ্গে কোরবানি উপলক্ষে যুক্ত হয়েছে আরও ৫টি বিশেষ হাট। খাগড়াছড়ির ৫২টি স্থানে রয়েছে কোরবানীর পশুর হাট। রংপুরের ৫৯টি হাটে চলছে কোরবানির পশুর বেচাকেনা।
সারাদেশেই কোরবানি উপলক্ষে ছোট ও মাঝারি আকারের গরুর ব্যাপক চাহিদা দেখা যায়। এসব গরুর জন্য গত বছরের তুলনায় ২০-২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়তি দাম হাঁকানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন অধিকাংশ ক্রেতা। তবে ব্যাপারী এবং খামারিরা বলছেন, গো-খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়া, পরিবহন খাতে বাড়তি খরচ, অতি গরমে গরু পালনে অতিরিক্ত যত্নসহ নানাবিধ কারণে গরুর দাম বেড়ে গেলেও, ন্যায্য দাম হাঁকাচ্ছেন না ক্রেতারা। সময় সংবাদের জেলা প্রতিবেদকদের পাঠানো তথ্যানুযায়ী, জেলাভেদে গরুর দামের তারতম্য থাকলেও, ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকাতে মিলছে এসব ছোট ও মাঝারি আকারের গরু।
গত বছরের তুলনায় গরুর দাম ২০-২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়তি দাম হাঁকানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন অধিকাংশ ক্রেতা। ছবি: সময় সংবাদ
রাজধানীর চিত্র
গরুতে কানায় কানায় পূর্ণ রাজধানীর পশুর হাটগুলো। সবমিলিয়ে ঢাকায় ২০টি হাট থেকে পশু কিনতে পারছেন ক্রেতারা। গাবতলী, উত্তরার দিয়াবাড়ি- বিভিন্ন হাট ঘুরে দেখা যায়, গত বছরের তুলনায় লাখ টাকার গরুতে ২০-২৫ হাজার টাকা বাড়তি দাম হাঁকাচ্ছেন খামারিরা। ক্রেতারা বলছেন, হাটগুলোতে ৩ মণ ওজনের একটি গরুর দাম হাঁকানো হচ্ছে ১ লাখ ২০ থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা; যা গত বছর ছিল ১ লাখ ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর ৫ মণ ওজনের গরুর দাম চাওয়া হচ্ছে ১ লাখ ৭০ থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত। যদিও এ অভিযোগ মানতে রাজি নন ব্যবসায়ীরা।
আবদুল্লাহ আল ফাহাদ নামে এক ক্রেতা বলেন, গত বছরের তুলনায় গরুপ্রতি প্রায় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা বেশি দাম হাঁকাচ্ছেন বিক্রেতারা। এবার মধ্যবিত্তদের জন্য পছন্দমতো গরু পাওয়া কষ্ট হয়ে যাবে।
খাসিরও বাড়তি দাম হাঁকানো হচ্ছে বলে অভিযোগ ক্রেতাদের। ১০ কেজি ওজনের খাসির দাম হাঁকানো হচ্ছে ৮ হাজার টাকা আর ৬০ কেজি ওজনের খাসির দাম চাওয়া হচ্ছে ৪০ হাজার টাকা।
রাজশাহী
রাজশাহীতে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ২৫টি কোরবানির পশুর হাট আছে। এরমধ্যে উত্তরবঙ্গের মধ্যে অন্যতম বড় কোরবানির পশু কেনাবেচার হাট রাজশাহীর সিটি হাট।
রাজশাহীর কয়েকটি হাট ঘুরে সময় সংবাদের প্রতিবেদকের পাঠানো তথ্যমতে, হাটে ছোট ও মাঝারি গরুর চাহিদাই বেশি। ২ মণ ওজনের ছোট গরু ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া ৬ মণ ওজনের মাঝারি আকারের গরু বিক্রি হচ্ছে ২ লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকায়; আর ১০ থেকে ১২ মণ ওজনের গরু বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ টাকায়।
ফারুক নামের এক ক্রেতা জানান, কোরবানি উপলক্ষে সবাই ঈদের ২-৩ দিন আগে থেকে গরু কিনে থাকে। এবার হাটগুলোতে গত বছরের তুলনায় ২০-৩০ হাজার টাকা দাম বেশি চাওয়া হচ্ছে। ঈদের আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, গরুর দাম কমে কিনা সেটা দেখার জন্য।
সিটি হাটের একজন বিক্রেতা জানান, এবার প্রচন্ড গরমে গরুর দাম এমনিতেই বেশি। তাছাড়া গরু পালনে প্রচুর খরচ বেড়েছে। দামে বনিবনা না হওয়ায় এখনও হাটে তেমন বেচাকেনা নেই। তবে শুক্রবার থেকে বিক্রি বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
জেলার প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, রাজশাহী জেলায় এবার ৪ লাখ ৬৬ হাজার ১৯৬টি কোরবানির পশু লালনপালন করা হয়েছে। এরমধ্যে রাজশাহী জেলার চাহিদা রয়েছে ৩ লাখ ২৪ হাজার ৯৭৭টি পশু। জেলার চাহিদা মিটিয়ে ১ লাখ ৪১ হাজার ২১৯টি কোরবানির পশু দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রির জন্য চলে যাচ্ছে।
রংপুর
বেতগাড়ী, লালবাগ, বুড়ির হাট, শটিবাড়ি হাটসহ স্থায়ী-অস্থায়ী মিলে রংপুর জেলার ৫৯ টি হাটে চলছে কোরবানির পশু বেচাকেনা। সময় সংবাদের রংপুর জেলা প্রতিবেদক বেশ কয়েকটি হাট ঘুরে দেখতে পান, কোরবানির পশু বেচাকেনা শুরু হয়েছে পুরোদমে। তবে দাম নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতাদের রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
এ জেলার বুড়ির হাটে গরু কিনতে আসা আকতার হোসেন জানান, বাজারে গরু বিক্রেতার চেয়ে ব্যবসায়ী আর দালালের উপস্থিতি অনেক বেশি। এ কারণে গরুর দাম অনেক বেশি চাওয়া হচ্ছে। যে গরু ১ লাখ টাকায় বিক্রি হবে তার দাম চাওয়া হচ্ছে দেড় লাখ টাকা।
এছাড়া লালবাগ এলাকার আব্দুল হালিম নামে আরেক ক্রেতা বলেন, ‘৩-৪টি বাজার ঘুরে ১ লাখ ২৭ হাজার টাকায় একটি গরু কিনেছি। তবে আমার মনে হয়েছে, গতবছর এই গরু সর্বোচ্চ ১ লাখ ১০ হাজার টাকায় পাওয়া যেত।’
অধিকাংশ ক্রেতার এ ধরনের অভিযোগকে তোয়াক্কা না করে, বরং গরুর ন্যায্য দাম হাঁকানো হচ্ছে না বলে উল্টো অভিযোগ করেছেন বিক্রেতারা।
দেশি জাতের দুইটি মাঝারি ষাঁড় নিয়ে বুড়ির হাটে বিক্রি করতে এসেছেন গংগাচড়ার খামারি তারিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘গত একবছর ধরে গরু দুইটা ঈদে বিক্রির জন্য পালন করা হয়েছে। এর মধ্যে বড়টার দাম চাওয়া হয়েছে দেড় লাখ টাকা আর ছোটটা ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এখন পর্যন্ত বড় গরুর জন্য ১ লাখ আর ছোটটার ৮০ হাজার টাকা হাঁকিয়েছেন ক্রেতারা। এই দামে বেচলে খামারিরা ক্ষতির মুখে পড়বে।’
রংপুর জেলায় প্রায় ২৫ হাজার খামারি এবার কোরবানির জন্য ৩ লাখ ৬০ হাজার পশু প্রস্তুত করেছেন। জেলার চাহিদা মেটার পরও প্রায় দেড় লাখ পশু উদ্বৃত্ত থাকবে বলে জানায় জেলার প্রাণিসম্পদ অধিদফতর। এর বাইরেও জেলার প্রায় ৫০টি খামারে অনলাইনে চলছে পশু বেচাকেনা। খামার পর্যায়ে ৪৬০-৫০০ টাকা কেজি দরে চলছে এসব গরুর বেচাকেনা।
খুলনা
খুলনা জেলায় এ বছর ১০টিরও বেশি নিয়মিত পশুর হাট বসেছে। এর সঙ্গে কোরবানি উপলক্ষে যুক্ত হয়েছে আরও ৫টি বিশেষ হাট। খুলনার হাটগুলো ঘুরে দেখা গেছে, ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা দামের গরুর চাহিদা বেশি। হাটেও এই দামের গরু বেশি উঠেছে।
খুলনার সবচেয়ে বড় হাটগুলোর একটি ডুমুরিয়া উপজেলার আঠারো মাইল হাট। ৩টি মাঠ, সড়ক মিলে কোরবানির জন্য দেড় হাজারেরও বেশি গরু এ হাটে জড়ো করেছেন বেপারি এবং খামারিরা। তবে অনেকেই গরু কিনতে না পেরে পরবর্তী হাটের জন্য অপেক্ষা করছেন।
ডুমুরিয়া এলাকায় নিজ খামারে ১০টি গরু লালনপালন করেছেন সমীর হোসেন। সবগুলো গরু হাটে তুললেও বিক্রি করতে পেরেছেন মাত্র ২টি। সমীর বলেন, ‘আমার গরুর পেছনে যে পরিমাণ খরচ হয়েছে, সে অনুযায়ী দাম বলছেন না ক্রেতারা। সবগুলো গরুই ১ থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে। তবু ঠিকঠাক দাম মিলছে না।’ সঠিক দাম না পেলে গরু বিক্রি না করে প্রয়োজনে আরও এক বছর লালনপালন করবেন বলেও জানান এই খামারি।
খুলনা মহানগরীর ফারাজি পাড়া এলাকা থেকে আঠারো মাইল হাটে এসেছেন তৌফিকুল নামের এক চাকরিজীবী। বেশ কয়েকটি গরু তার পছন্দ হলেও দামে পোষায়নি তার। তিনি বলেন, ‘আমার টার্গেট ১ লাখ টাকার মধ্যে। তবে যে গরু পছন্দ হচ্ছে, তার দাম চাওয়া হচ্ছে দেড় লাখ টাকার মতো। এক লাখ টাকায় যেসব গরুর দাম চাচ্ছে, সেগুলো বেশ ছোট।’ তবে কোরবানির হাটের শেষ মুহূর্তে কাঙ্ক্ষিত দামে পছন্দের গরু মিলবে বলে আশা করছেন এই ক্রেতা।
একই চিত্র জেলার খর্নিয়া, শাহপুর, ফুলতলা, তেরখাদাসহ সবগুলো হাটের। অধিকাংশ ক্রেতা চাচ্ছেন ১ লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা দামের মধ্যে গরু কিনতে। এ কারণে তুলনামূলক ছোট গরুর দাম ১ লাখ টাকার আশপাশে হাঁকছেন বিক্রেতারা। তবে একটু বড় আকারের গরুর দাম তুলনামূলক কম। খুলনার এই হাটগুলোতে বড় গরুর সংখ্যাও বেশ কম।
খাগড়াছড়ি
খাগড়াছড়ির ৯টি উপজেলায় ৫২টি স্থানে রয়েছে কোরবানীর পশুর হাট। এসব হাটে ছোট আকারের গরু ৫০ থেকে ৬০ হাজার, মাঝারি আকারের গরু ৬০ থেকে ৮০ হাজার এবং বড় গরু ১ থেকে ২ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ দামে কিছুটা ক্ষতির মুখে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন খামারি ও বিক্রেতারা, তবে খুশী ক্রেতারা। অপেক্ষাকৃত কম দামে গরু মিলায়, এসব হাটে পাইকারদের আনাগোনা খুব বেশি।
সোনা বরণ চাকমা নামের একজন বিক্রেতা জানান, হাটে ৮টি গরু নিয়ে আসা হয়েছে। এর মধ্যে ৩টি গরু বিক্রি হয়েছে। কোরবানির এখনও আরও কয়েকদিন বাকি থাকায় ক্রেতারা দরকষাকষি করছেন। গো-খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় গরু লালনপালনে খরচ রেড়েছে। তবুও প্রত্যাশিত মূল্য না পাওয়ায় খামারিরা হতাশ বলে জানিয়েছেন তিনি।
খাগড়াছড়ির জেলায় ১৫ হাজার ২৬টি গরু, ৪২ হাজারের কাছাকাছি ছাগল, ২৪টি মহিষ এবং ৪২৫টি ভেড়া কোরবানি উপযোগী রয়েছে বলে জানিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর। জেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. জরহর লাল চাকমা জানান, খাগড়াছড়িতে এবার ৫৪ হাজারেরও বেশি পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এর বিপরীতে চাহিদা রয়েছে প্রায় ২৬ হাজার পশুর। এরইমধ্যে অতিরিক্ত পশু দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
Leave a Reply