এই বছর হজ পালন করতে গিয়ে ১৩০১ জন হাজির মৃত্যু হয়েছে। যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, মিশর, ইন্দোনেশিয়াসহ ১০টি দেশের নাগরিক রয়েছেন। অনুমোদন ছাড়া হজে অংশ নেয়া, তীব্র সূর্যতাপ ও গরমের মধ্যে যথেষ্ট বিশ্রাম ছাড়া লম্বা দূরত্বে হাঁটার কারণে বেশিরভাগ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ।
এবার সৌদি আরবে তাপমাত্রা ছায়ার মধ্যেই ৫১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত গিয়েছে। এই পরিস্থিতিকেই একটা বড় কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় উচ্চতাপ ও পানিশূন্যতা এড়াতে সতর্কতা জারি করলেও অনেক হাজি তীব্র গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা এবং হিটস্ট্রোকের শিকার হয়েছেন।
দুই ডজনের বেশি দেশ থেকে হজ পালন করতে আসা মানুষের মধ্যে সর্বাধিক মৃত্যু হয়েছে মিশরীয়দের। একজন আরব কূটনীতিক জানিয়েছে, মিশরের যে ৬৫৮ জন ব্যক্তির মৃত্যুর কথা বলা হচ্ছে তার প্রায় সবই চরম তাপের কারণে হয়েছে। এই হাজিদের অনেকেরই যথাযথ হজ পারমিট ছিল না, যার ফলে তাদের ক্ষেত্রে হাজিদের জন্য নির্ধারিত সহযোগিতা বা সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি ছিল।
বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের নিউজডে-কে নাইজেরিয়ান হাজি আইশা ইদ্রিস বলেছেন, ‘শুধু আল্লাহর রহমতে আমি বেঁচে গেছি, কারণ সেখানে অত্যধিক গরম ছিল। তারা কাবার সব দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল, আমাদের ছাদ ব্যবহার করতে হয়েছিল, সেখানে প্রচণ্ড তাপে যেন জ্বলছিল।
তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে ছাতা ব্যবহার করতে হয়েছিল এবং ক্রমাগত জমজম পানি (পবিত্র পানি) দিয়ে নিজেকে ভিজিয়ে রাখতে হয়েছিল। এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিল আমি অজ্ঞান হয়ে যাবো, তখন আমাকে ছাতা দিয়ে একজনের সাহায্য করতে হয়েছিল। আমি ভাবিনি যে তাপ এত তীব্র হবে।’
হজের সময় গরমের কারণে মৃত্যুর ঘটনা নতুন নয় এবং ১৪০০ সাল থেকে মৃত্যুর তথ্য নথিভুক্ত করা হচ্ছে। গত বছরও গরমের কারণে কোনও না কোনওভাবে আক্রান্ত হওয়ার ২০০০ ঘটনার তথ্য দিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ।
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন যে বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে সামনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। ক্লাইমেট অ্যানালিটিক্সের কার্ল-ফ্রেডরিচ শ্লেউসনার রয়টার্স নিউজ এজেন্সিকে বিশ্বের তাপমাত্রার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তার গবেষণা অনুযায়ী শিল্প বিপ্লবের আগের সময়ের তুলনায় বিশ্বের তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি বাড়লে হজের সময় হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি পাঁচ গুণ বেড়ে যেতে পারে।
অতিরিক্ত ভিড় এবং পরিচ্ছন্নতাজনিত সমস্যা
বিভিন্ন মানুষের বয়ান থেকে যেমনটা জানা যাচ্ছে সৌদি কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে, যার ফলে হজযাত্রীদের জন্য নির্ধারিত অনেক এলাকায় বিভিন্ন সংকট দেখা গেছে।
ইসলামাবাদ থেকে আসা ৩৮ বছর বয়সী আমিনা (ছদ্মনাম) বলেন, ‘মক্কার তাপে আমাদের তাঁবুগুলিতে কোনও এয়ার কন্ডিশনার ছিল না। যে কুলারগুলি বসানো হয়েছিল তাতে বেশিরভাগ সময় পানি ছিল না। এই তাঁবুগুলি এতটা শ্বাসরুদ্ধকর ছিল যে আমরা ঘেমে ভিজে যাচ্ছিলাম এবং এটি একটি ভয়ানক অভিজ্ঞতা ছিল।’
পরিবহন সমস্যা
প্রচণ্ড গরমের মধ্যেই হাজিরা প্রায়শই দীর্ঘ পথ হাঁটতে বাধ্য হয়েছেন। এজন্য অনেকে বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা আটকে দেয়া এবং খারাপ পরিবহন ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন। একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাকিস্তানি হাজি বলেন, ‘আমাদের সাত কিলোমিটার দীর্ঘ পথে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল যেখানে কোনও পানি এবং ছায়া ছিল না। পুলিশ ব্যারিকেড বসিয়ে আমাদের অপ্রয়োজনীয়ভাবে দীর্ঘ দূরত্ব হাঁটতে বাধ্য করেছে।’
বিলম্বিত চিকিৎসা সহায়তা
অনেক হাজিই পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা পাননি বলে জানা গেছে। অনেকে বলছেন যারা তীব্র গরমে ক্লান্তি বা অন্যান্য স্বাস্থ্যসমস্যায় ভুগেছেন তাদের জন্য অ্যাম্বুলেন্স বা প্রাথমিক চিকিৎসা সহজে পাওয়ার উপায় ছিল না।
হজযাত্রীদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে বরাদ্দকৃত সম্পদের কথা তুলে ধরেছেন সৌদি স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সরকারি এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে , তারা ৬৫০০ শয্যার সক্ষমতাসম্পন্ন ১৮৯টি হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, মোবাইল ক্লিনিক চিকিৎসা সেবায় যুক্ত করেছে এবং ৪০ হাজারের বেশি চিকিৎসা, প্রযুক্তি, প্রশাসনিক বিষয়ক কর্মী এবং স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দিয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে- সেখানে ৩৭০ টির বেশি অ্যাম্বুলেন্স, সাতটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, শক্তিশালী লজিস্টিক নেটওয়ার্কসম্পন্ন ১২ টি ল্যাবরেটরি, ৬০ টি সরবরাহ ট্রাক এবং তিনটি ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা সামগ্রী সংবলিত গুদাম স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত করা হয়েছে এবং পবিত্র স্থাপনার বিভিন্ন জায়গায় সুকৌশলে স্থাপন করা হয়েছে।
নথিবিহীন হাজিরা
হজ করতে, একজন হাজিকে একটি বিশেষ হজ ভিসার জন্য আবেদন করতে হয়। কিন্তু কিছু ব্যক্তি সঠিক কাগজপত্র ছাড়াই হজে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এই ’অনুমোদনহীন হজ’ সমস্যা অতিরিক্ত মৃত্যুর জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়। যারা সঠিক কাগজপত্র ছাড়া হজ করেন তারা কর্তৃপক্ষকে এড়িয়ে চলেন, এমনকি প্রায়শই সাহায্যের প্রয়োজন হলেও। কিছু তাঁবুর ভিড়ের জন্য তাদেরকে দায়ী করেছেন কর্তৃপক্ষ।
ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় হজ এবং উমরাহ কমিশনের চেয়ারম্যান মুস্তোলিহ সিরাজ বলেছেন, ‘আমাদের সন্দেহ যাদের হজের ভিসা নেই তারা হজ এলাকায় অনুপ্রবেশ করেছে।’
একজন আরব কূটনীতিকের বরাত দিয়ে এএফপি জানিয়েছে- এই মৌসুমে অন্তত ৬৫৮ জন মিশরীয় মারা গেছেন, যার মধ্যে ৬৩০ জনের হজ পারমিট ছিল না।
জাতীয় হজ ও উমরাহ কমিটির উপদেষ্টা সাদ আল-কুরাইশি বলেন: ‘যাদের কাছে হজের ভিসা নেই তাদেরকে বরদাশত করা হবে না এবং তাদের অবশ্যই দেশে ফিরে যেতে হবে। অনিয়মিত হাজিদের চিহ্নিত করা হয় নুসুক কার্ডের মাধ্যমে, যা সরকারি হাজিদের দেওয়া হয় এবং তাতে পবিত্র স্থানে প্রবেশের জন্য একটি বারকোড থাকে।’
বয়োজ্যেষ্ঠ, রুগ্ন বা অসুস্থ তীর্থযাত্রী
অনেক হাজি জীবনের শেষের দিকে হজে যান, আবার অনেকে আশা করেন যে মৃত্যু হলে যেন সেখানেই হয়। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের মুসলমানরা হজ পালনের সময় মারা যাওয়া সৌভাগ্যের বিষয় বলে মনে করেন। মনে করা হয় এটি একটি বিশেষ মর্যাদা প্রদান করে। হজে প্রতি বছর মৃত্যুর এটি আরেকটি কারণ। ২০২২-২৩ মৌসুমে প্রায় দুইশো জন মারা গিয়েছিল।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
Leave a Reply