অভিজাত এলাকায় দুটি ফ্ল্যাট, শপিং মলে তিনটি দোকান, দামি প্রাইভেটকার, ব্যাংকে কোটি টাকা; এসবের মালিক এক নারী, তার নাম আনোয়ারা বেগম। পেশায় গৃহিণী আনোয়ারা এতো সম্পদের মালিক হলেন কীভাবে? তবে কি ‘আলাদিনের চেরাগ’ পেয়েছিলেন আনোয়ারা?
না, আলাদিনের চেরাগ পাননি। আনোয়ারার স্বামী নজরুল ইসলাম ভূমি কার্যালয়ের (বরখাস্ত) একজন শিকলবাহক (চেইনম্যান)। মূলত তার অবৈধ আয়ে কোটিপতি বনে গেছেন স্ত্রী- এমনটিই বেরিয়ে এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে।
অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের দায়ে সোমবার (২৪ জুন) নজরুল ও তার স্ত্রী আনোয়ারাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে দুদক।
অভিযোগপত্রে দুদক উল্লেখ করেছে, ১১ কোটি ২১ লাখ ৬৮ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন নজরুল ও আনোয়ারা। অভিযোগপত্র অন্য যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হলেন- নজরুলের শ্যালিকা কোহিনুর আকতার, দোকান কর্মচারী শাহাদাত হোসেন, আত্মীয় জামাল উদ্দিন, সামসুন নাহার চৌধুরী ও শামসুল আলম। নজরুল জামিনে রয়েছেন। বাকিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির জন্য আদালতে আবেদন করেছে দুদক।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদক চট্টগ্রামের উপপরিচালক মোহাম্মদ আতিকুল আলম বলেন, নজরুল ও তার স্ত্রীসহ সাতজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। অবৈধ আয়ে এসব সম্পদের মালিক হয়েছেন তারা।
দুদকের তদন্তে জানা গেছে, নগরের জিইসি ওআর নিজাম রোড এলাকায় দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে নজরুল ও তার স্ত্রীর নামে। এরমধ্যে দুই হাজার ৭০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের মূল্য এক কোটি তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং এক হাজার ৬২০ বর্গফুটের অপর ফ্ল্যাটটির মূল্য এক কোটি দুই লাখ ৩৪ হাজার টাকা। গ্রামের বাড়ি হাটহাজারীতেও ৮২ লাখ ৪৯ হাজার টাকা মূল্যের একটি তিনতলা বাড়ি রয়েছে নজরুলের নামে।
এছাড়া নগরের ষোলশহর এলাকার চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্সে তিনটি দোকান রয়েছে স্বামী-স্ত্রীর নামে। তিনটির মধ্যে দ্বিতীয় তলায় থাকা দোকানটির মূল্য ৮৫ লাখ টাকা, একই তলায় থাকা আরেক দোকানের মূল্য ছয় লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং নিচতলায় থাকা দোকানটির মূল্য তিন লাখ ৭০ হাজার টাকা। এছাড়াও স্ত্রীর নামে রয়েছে সাড়ে ২২ লাখ টাকা দামের প্রাইভেটকার।
নজরুলের শ্যালিকা কোহিনুর আক্তারের ব্যাংক হিসাবে দুই কোটি দুই লাখ ৫৫ হাজার টাকা, দোকান কর্মচারী শাহাদাত হোসেনের হিসাবে তিন কোটি ১৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকা, আত্মীয় শামসুল আলমের হিসাবে চার কোটি ৯০ লাখ টাকা, শামসুন নাহারের হিসাবে তিন কোটি টাকা ও জামাল উদ্দিনের হিসাবে ৭১ লাখ ২২ হাজার টাকার তথ্য পায় দুদক। অথচ কোহিনুর ও শামসুন নাহার দুজনই গৃহিণী। অন্যরা ব্যবসায়ী দাবি করলেও ব্যবসার কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি।
দুদক সূত্র জানায়, ১৯৯৪ সালে এক হাজার ৮০০ টাকা বেতনে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন নজরুল। দুদকের হাতে ধরা পড়ার আগে ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি বেতন-ভাতা পান ২৯ লাখ ৬২ হাজার ৮৬৬ টাকা। দুই ছেলে পড়ালেখা ও সাংসারিক খরচ বাবদ অর্ধেক বাদ দিলে তার কাছে থাকার কথা ১৪ লাখ ৮১ হাজার ৪৩৩ টাকা।
নজরুলের বড় ছেলে সম্প্রতি লন্ডন থেকে এমবিএ করেছেন। ছোট ছেলে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ পড়ছেন।
নজরুল ইসলাম একসময় চট্টগ্রাম জেলা ভূমি অধিগ্রহণ কার্যালয়ের শিকলবাহক (চেইনম্যান) ছিলেন। ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি আকস্মিক পরিদর্শনে গিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে নজরুলসহ তিনজনকে তাৎক্ষণিক বদলির নির্দেশ দেন তৎকালীন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। এরপর নজরুলকে ফটিকছড়ি উপজেলা পরিষদে বদলি করা হয়।
২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্সে স্ত্রীর মালিকানাধীন দোকানে দুদকের হাতে ধরা পড়েন নজরুল ইসলাম। তার সঙ্গে ছিলেন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অফিস সহকারী তছলিম উদ্দিন। ওই সময় নজরুলের কাছে প্রায় ৯১ লাখ টাকার চেক ও নগদ সাড়ে সাত লাখ টাকা পাওয়া যায়। এ ঘটনায় মামলা করে দুদক। সাড়ে চার বছর তদন্ত শেষে এ মামলার অভিযোগপত্র দেয় দুদক।
মামলায় শুরুতে নজরুল ও তার স্ত্রীকে আসামি করা হলেও তদন্তে অন্য পাঁচজনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। এসব অর্থ স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রূপান্তরে স্বামী-স্ত্রীকে সহযোগিতা করেন তারা। আনোয়ারা বেগমের নিকটাত্মীয় শামসুল আলম। তিনি নিজের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল বলে দাবি করলেও তদন্তকালে দুদককে কোনো তথ্য-প্রমাণ দেখাতে পারেননি।
Leave a Reply