প্রশাসনে উপসচিব পদে পদোন্নতি পেতে লিখিত পরীক্ষা দিতে হবে। এক্ষেত্রে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার থেকে ৫০ এবং অন্য ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ পদোন্নতি দেওয়া হবে-এমন বিধান রেখে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এছাড়া উপসচিব ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত ঋণে গাড়ির সুবিধা বাতিল, প্রশাসন ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ বিভাগীয় কমিশনার, অন্য ক্যাডারে মহাপরিচালক (ডিজি), আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করতে সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস প্রবর্তন এবং ২৬টি ক্যাডারকে ১২টি ক্লাস্টারে একাধিক ক্যাডার অন্তর্ভুক্ত, স্থায়ীভাবে জনপ্রশাসন সংস্কার ও পে-কমিশন গঠনসহ প্রায় পৌনে দুইশ সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে যুগের পর যুগ গোটা প্রশাসনে যে একক কর্তৃত্ব ছিল বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের, তা অনেকাংশে কমে আসবে। পাশাপাশি প্রশাসনের সঙ্গে অন্য ক্যাডারের যে বৈষম্য ছিল, সেটি দূর হবে-এমন প্রত্যাশা সংস্কার কমিশন সংশ্লিষ্টদের।
আজ (বুধবার) দুপুর ১২টায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হবে। মঙ্গলবার সচিবালয়ে বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী। তিনি বলেন, কমিশন থেকে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে, সেগুলো সবই বাস্তবায়ন করা সম্ভব। অসম্ভব কিছু হলে তো সুপারিশ করতাম না। এক প্রশ্নে মুয়ীদ চৌধুরী বলেন, সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা কিংবা না করা সরকারের বিষয়। কমিশনের সুপারিশ যা থাকছে সেগুলো বাস্তবায়ন অসম্ভব নয়। প্রতিবেদনে শতাধিক সুপারিশ থাকছে জানিয়ে তিনি বলেন, এর বাইরে আমি কিছু জানাতে পারব না। এ সময় পাশে থাকা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও সংস্কার কমিশনের সদস্য সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর সেটি হবে পাবলিক ডকুমেন্ট। তখন ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে, সবাই জানবেন এবং আর কোনো ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকবে না। এরপর কমিশন প্রধানসহ সদস্যরা প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করেন।
গত ৩ অক্টোবর ৮ সদস্যের জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। পরে কমিশনের সদস্য সংখ্যা আরও তিনজন বাড়ানো হয়। জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন ব্যবস্থা করে তুলতে এ কমিশন গঠন করা হয়। ৯০ দিনের (৩ মাস) মধ্যে প্রস্তুত করা প্রতিবেদন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করতে বলা হয়। এরপর তিন দফা বাড়িয়ে কমিশনের মেয়াদ ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় বেঁধে দেওয়া বর্ধিত সময়ের ১০ দিন আগেই প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হচ্ছে।
সংস্কার কমিশন সূত্রে জানা গেছে, কমিশনের সুপারিশে স্থায়ীভাবে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন চালু রাখার সুপারিশ করতে পারে। জনপ্রশাসনে সৃষ্ট সমস্যা, বৈষম্য ওই কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সমাধান হবে। স্থায়ী সংস্কার কমিশন সব সার্ভিস বা ক্যাডার নিয়ে গবেষণা করবে। কোথায় কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে তা সরকারকে অবহিত করবে। তাহলে দেশের কোনো সার্ভিসে বা ক্যাডারে আর বৈষম্য থাকবে না।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, বিরাজমান আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করতে সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস (এসইএস) নামে একটি সার্ভিস চালুর প্রস্তাব করতে পারে কমিশন। উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত কর্মকর্তারা নতুন এই সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত হবে। এই সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত হতে পরীক্ষা দিতে হবে প্রশাসনসহ অন্য ক্যাডার কর্মকর্তারা। উত্তীর্ণ কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ এবং অন্যান্য ক্যাডার বা সার্ভিস থেকে ৫০ শতাংশ পদ পূরণ করা হবে। পরীক্ষা নেবে সরকারি কর্মকমিশন। পরীক্ষায় সর্বনিম্ন ৭০ নম্বর পেলে উত্তীর্ণ বিবেচনা করা হবে। বিদ্যমান বিধিমালা অনুযায়ী, উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫ শতাংশ এবং অন্য ক্যাডার থেকে ২৫ শতাংশ নেওয়া হয়। এছাড়া শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের জন্য আলাদা সার্ভিস কমিশন গঠনেরও প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়া প্রতিবেদনে।
নতুন এসইএস গঠনের বিষয়ে সংস্কার কমিশন মনে করছে সচিবালয়ের উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত পদগুলোতে নিয়োগ পাওয়ার প্রত্যাশা প্রতিটি সার্ভিস কর্মকর্তাদের থাকে। সেক্ষেত্রে মেধার ভিত্তিতে উচ্চ পদগুলোতে আরোহণের সুযোগ সৃষ্টি করাই যুক্তিসংগত। বিশ্বের বহু দেশেই এই নীতি অনুসরণ করা হয়। তাছাড়া ক্যাডারের সবাইকে সচিব করা বা সচিব হওয়া অসম্ভব।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন উপসচিব ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের জন্য সুদমুক্ত গাড়ি ঋণ এবং গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ভাতা বাতিল করার সুপারিশ করতে পারে। বর্তমানে উপসচিব এবং তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা গাড়ি কেনার জন্য ৩০ লাখ টাকা ঋণ এবং একজন চালক নিয়োগ ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচের জন্য মাসিক ৫০ হাজার টাকা ভাতা পান। কমিশনের সদস্যরা করদাতাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করার জন্য এই সুবিধাগুলো বন্ধ করতে চান। সেই সঙ্গে তারা মনে করেন প্রশাসন ক্যাডারে নেই-এমন কর্মকর্তাদের প্রতি এটি বৈষম্যমূলক।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, খসড়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিভাগীয় কমিশনারকে প্রশাসন ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ এবং অন্যদের জন্য ডিজি পদ থাকবে। ছোট ক্যাডার হিসাবে সমবায় ও খাদ্য ক্যাডারকে প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে মার্জ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্য ক্যাডারকে কাস্টমস ক্যাডারের সঙ্গে আত্তীকরণের সুপারিশ করা হয়েছে। টেকনিক্যাল ক্যাডারগুলোর সমন্বয়ে প্রকৌশল সার্ভিস গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা উদাহরণ দিয়ে বলেন, প্রকৌশলীদের মধ্যে পূর্ত ক্যাডারের তিনটি অংশ, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের প্রকৌশলী, রেল বাণিজ্যিক ও কারিগরি প্রকৌশলীসহ এই সার্ভিস গঠন করার প্রস্তাব করা হতে পারে। কৃষি, বাণিজ্য, খাদ্য এ জাতীয় ক্যাডারগুলোর সমন্বয়ে কৃষি সার্ভিস গঠনের প্রস্তাব হতে পারে। রাজস্ব সার্ভিস, তথ্য সার্ভিস নামে ১২টি সার্ভিস করার প্রস্তাব করা হতে পারে।
উপজেলায় ইউএনও’র পাশাপাশি একজন সিনিয়র সহকারী সচিবকে উপজেলা পরিষদের সচিব হিসাবে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে খসড়ায়। সংস্কার কমিশন সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এই পদক্ষেপ ইউএনও এবং উপজেলা চেয়ারম্যানদের মধ্যে চলমান রেষারেষির অবসান হবে। দেশের পুরনো চারটি বিভাগকে চারটি প্রদেশ করার সুপারিশ করার পাশাপাশি বিদ্যমান আটটি প্রশাসনিক বিভাগের বাইরেও কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে নতুন বিভাগ করার প্রস্তাব থাকতে পারে। যোগাযোগব্যবস্থা ও ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় রংপুরের দুটি উপজেলা, ঢাকা বিভাগের দু-একটি জেলাকে অন্তর্ভুক্ত করে ময়মনসিংহ বিভাগ পুনর্গঠনের প্রস্তাব থাকতে পারে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী দেশের এই পুরনো চার বিভাগকে চারটি প্রদেশ করার সুপারিশ থাকতে পারে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে চাকরিপ্রত্যাশীদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য ৩২ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো হয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির জন্য গঠিত কমিটি অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধির সুপারিশ করতে পারেনি। কারণ কমিটির কার্যপরিধিতে অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধির সুপারিশ করার কোনো এখতিয়ার ছিল না। সে কারণে কমিশন সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়সসীমা যৌক্তিকভাবে বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য স্থায়ী পে-কমিশন গঠনের সুপারিশ করতে পারে। এ পদ্ধতিতে দ্রব্যমূল্যের স্ফীতি ঘটলে বেতন বাড়বে আবার দ্রব্যমূল্য কমলে বেতন কমবে। প্রতিদিন সরকারি সংস্থাগুলো বাজার মনিটরিং করবে। প্রতিদিনের বাজারদর বিশ্লেষণ করে বেতন বৃদ্ধি বা কমার হার নির্ধারণ করা হবে।
Leave a Reply