নিজস্ব প্রতিবেদক : ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ ও গণহত্যা চালানোর জন্য শেখ হাসিনার নির্দেশ তার টেলিফোন কথোপকথন রেকর্ডে পাওয়া গেছে। ১৬ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট রাত পর্যন্ত তার অনেকগুলো কলরেকর্ড উদ্ধার করা হয়েছে।
কলরেকর্ড পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে যাত্রা শুরুর গোড়ার দিকে অর্থাৎ ১৮ জুলাই হাসিনা তার উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিকীর সঙ্গে দুইবার কথা বলেন। এর মধ্যে একবার কথা বলেছেন ১৩৮ সেকেন্ড (দুই মিনিট ১৮ সেকেন্ড)। আরেকবার এক মিনিট ১৩ সেকেন্ড (৭৩ সেকেন্ড)। এ দুটি কথোপকথনে নিরীহ, নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, গুলিবর্ষণ করার নির্দেশ দেন হাসিনা।
পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় হামলা ও অগ্নিসংযোগের নির্দেশনা দেওয়া হয়। প্রাপ্ত অনেকগুলো কলরেকর্ডে দেখা গেছে, জুলাইয়ের শেষদিকে এসে শেখ হাসিনা বেশ কয়েকবার প্রাণঘাতী মারণাস্ত্র (লেথাল উইপন) ব্যবহার করার নির্দেশ দেন। পতনের আগ পর্যন্ত প্রতিদিনই তিনি বিভিন্ন বাহিনীর অনুগত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার আন্দোলন দমানোর জন্য শক্তি প্রয়োগের নির্দেশনা দিতেন। সংশ্লিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সূত্রে কলরেকর্ডের এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্রগুলো বলছে, আন্দোলন চলাকালে হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারেক সিদ্দিকী, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, বরখাস্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুজিবুর রহমান, এনএসআইয়ের সাবেক প্রধান টি এম জোবায়ের, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, পুলিশ কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার বিশ্বাসসহ বিশ্বস্ত কর্মকর্তাদের ভার্চুয়ালি নির্দেশনা দেন।
আন্দোলন চলাকালীন সময়ে কথা বলেছেন ডিজিএফআইয়ের তৎকালীন প্রধান হামিদুল হক, পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন ও র্যাব প্রধানের সঙ্গে। এর মধ্যে সবেচেয়ে বেশি কথা বলেছেন তারেক সিদ্দিকী, জিয়াউল আহসান এবং জেনারেল মুজিবের সঙ্গে।
সূত্রগুলো আরো বলছে, এখন পর্যন্ত যেসব কলরেকর্ড পাওয়া গেছে, তাতেও শেখ হাসিনার গণহত্যার সম্পৃক্ততার সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে। তবে পালিয়ে যাওয়ার আগে শেখ হাসিনার নির্দেশে অনেক কলরেকর্ড মুছে দেওয়া হয়।
বিশেষ করে তারেক সিদ্দিকী, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন অ্যান্ড মনিটরিং সেন্টারের তৎকালীন ডিজি জিয়াউল আহসান, সেনা কর্মকর্তা মুজিব, জোবায়েরের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলামত ধ্বংস করা হয়। এসব কর্মকর্তাকে সঠিকভাবে জেরা করতে পারলে আরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বের হয়ে আসবে বলে নিশ্চিত করে জানাচ্ছেন উচ্চপর্যায়ের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র।
এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ কেন নেওয়া যাচ্ছে না, তাতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন দায়িত্বশীলরা। জিয়াউল আহসানকে কেন এখনো তথ্য বের করার উপযোগী প্রক্রিয়ায় জিজ্ঞাসা করা যাচ্ছে না, তাতে বিস্ময় প্রকাশ করেছে সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল পক্ষ।
জানা গেছে, আন্দোলন চলাকালীন প্রায় সবকিছু একাই পরিচালনা করতেন শেখ হাসিনা। তবে বেশিরভাগ তথ্য জানতেন তারেক সিদ্দিকী। গণহত্যার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে সব সময় ভার্চুয়ালি যোগাযোগ করতেন শেখ হাসিনা।
মাফিয়া চক্রের আদলে এক কর্মকর্তাকে একটি নম্বর দিয়ে ফোন করতেন। যেটি দিয়ে অন্য কারো সঙ্গে কথা বলতেন না। এভাবে অনেকগুলো ফোন নম্বর ব্যবহার করতেন শেখ হাসিনা। সবগুলো নম্বরের তথ্য পাওয়া না গেলেও এ পর্যন্ত সাতটি নম্বরের তথ্য উদ্ঘাটন করা গেছে। এগুলোর বেশ কয়েকটি কলরেকর্ড উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
শেখ হাসিনার এসব নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে শুরু হওয়া আন্দোলন ৫ আগস্ট শেষ হওয়া পর্যন্ত তার অনুগত বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তা ও মাঠপর্যায়ের সদস্যরা রীতিমতো গণহত্যা চালিয়ে অন্তত ১ হাজার ৫০০ ছাত্র-জনতার জীবন কেড়ে নেয়।
বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন এ গণহত্যায় হাসিনার নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের হাত থেকে ছয় বছরের শিশু থেকে শুরু করে স্কুল, মাদরাসা, কলেজ, পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদালয়ের ছাত্র, চাকরিজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, খেটে খাওয়া মানুষ, বাদ যায়নি কেউই। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা।
Leave a Reply