ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম এবং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদিদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘটনাটি ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এর পেছনে অনেক কারণে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়েছে, যা আজ পর্যন্ত চলমান। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও পরবর্তী যুদ্ধে আরব-ইহুদি সংঘর্ষের বিস্তারিত ঘটনাবলী নিচে দেওয়া হলো:
১৯ শতকের শেষ দিকে এবং ২০ শতকের প্রথম দিকে, ইহুদিরা তাদের ধর্মীয় ভূমি হিসেবে পরিচিত ফিলিস্তিনে একটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা শুরু করেন। ১৮৯৭ সালে সিয়নের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বিশ্বব্যাপী ইহুদি জনগণের জন্য ফিলিস্তিনে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সমর্থন আদায়ের চেষ্টা হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার “বেলফোর ডিক্লারেশন” প্রকাশ করে, যেখানে তারা ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের জন্য একটি “জাতীয় হোম” প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ঘোষণা করে। এর ফলে ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের সংখ্যা বাড়তে থাকে, এবং স্থানীয় আরব জনগণের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়।
১৯৩০ সালের দশকে, ফিলিস্তিনের আরব জনগণ বুঝতে পারেন যে তারা ধীরে ধীরে জমি হারাচ্ছে, কারণ ইহুদিরা সেখানে বসবাস শুরু করছে এবং ভূমি ক্রয় করছে। এই পরিস্থিতিতে, ফিলিস্তিনি আরবরা বিদ্রোহ করতে শুরু করেন, যা ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা কঠোরভাবে দমন করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, ইহুদি জনগণের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তা জোরালো হয়, বিশেষ করে হিটলারের আক্রমণের পর ইহুদিরা বিপুল সংখ্যায় নিহত হওয়ার পর। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ একটি পরিকল্পনা পেশ করে, যার মধ্যে ফিলিস্তিনে দুটি রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব ছিল—একটি ইহুদিদের জন্য এবং অন্যটি আরবদের জন্য। যদিও ফিলিস্তিনি আরবরা এই পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি, ইহুদিরা তা মেনে নেয় এবং তারা তাদের জন্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে।
১৯৪৮ সালের ১৪ মে, ব্রিটেন ফিলিস্তিন থেকে চলে যাওয়ার পর, ইহুদি নেতারা স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এর পরপরই, পাঁচটি আরব দেশ—মিশর, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন এবং জর্ডান—ইসরায়েলকে আক্রমণ করে। এই যুদ্ধকে “আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ ১৯৪৮” বা “নাকবা” (ফিলিস্তিনিদের জন্য “প্রলয়ের দিন”) বলা হয়।
ইহুদিরা প্রথমে যুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছিলেন, তবে দ্রুত তাদের যুদ্ধের কৌশল এবং অস্ত্রের আধুনিকীকরণে তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে সফলতা অর্জন করতে থাকে। ইহুদি বাহিনীর নেতৃত্ব ছিল অনেক বেশি সংগঠিত এবং সুসংহত। তাদের সামনে আরব বাহিনী ছিল বিভক্ত এবং নেতৃত্বে বিভ্রান্তি ছিল। ১৯৪৮ সালের শেষদিকে, ইসরায়েল তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকা বৃদ্ধি করে এবং জেরুজালেমে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করে নেয়।
ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার পর, প্রায় সাত লাখ ফিলিস্তিনি তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায় বা বাস্তুচ্যুত হয়। তারা আশায় ছিল যে একটি সমাধান আসবে এবং তারা ফিরতে পারবে, কিন্তু ইসরায়েল তাদের ফিরতে দেয়নি। এই ঘটনা ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি জাতিগত দুর্ভাগ্য এবং শরণার্থী সংকট সৃষ্টি করে।
আরব দেশগুলোর মধ্যে কোনও সমন্বয় ছিল না, এবং তারা একযোগভাবে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। এই দুর্বল সমন্বয় এবং নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিশ্বাসের অভাবই তাদের পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও তারা কয়েকটি বড় আক্রমণ করেছে, তবে ইসরায়েলকে পরাজিত করা সম্ভব হয়নি।
১৯৪৮ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল আত্মরক্ষার জন্য লড়াই করে, এবং এই যুদ্ধে তারা কেবল স্বাধীনতা অর্জনই করেনি, বরং এটি তাদের সামরিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার একটি সুযোগ তৈরি করে। এর পরবর্তী দশকগুলোতে, ইসরায়েল সুপার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রযুক্তি, সামরিক শক্তি, এবং অর্থনৈতিক শক্তিতে উন্নতি লাভ করে।
ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তী যুদ্ধটি মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘকাল ধরে চলা সংঘর্ষের সূত্রপাত। আজও ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে দ্বন্দ্ব অব্যাহত রয়েছে, যেখানে ফিলিস্তিনিরা তাদের নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে এবং ইসরায়েল তাদের নিরাপত্তার প্রশ্নে উদ্বিগ্ন।
এটি একটি দীর্ঘ এবং জটিল ইতিহাস, এবং এর পরিণতি এখনও বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব ফেলছে।
Leave a Reply