বাসায় এসে শিশুটি কেঁদে কেঁদে বলল, ‘মা, বাবা গুলি খেয়েছে’

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে চারদিকে সহিংসতা আর কারফিউয়ের মধ্যে টানা কয়েকদিন রাজধানীর আব্দুল্লাহপুরের বাসায় বন্দি থেকে অস্থির হয়ে উঠেছিল আট বছরের ছেলেটি। তাই ছেলের বায়না পূরণ করতে ২১ জুলাই বিকালে সংঘর্ষ এড়িয়ে নিরিবিলিতে একটু সময়ের জন্য ঘুরতে বেরিয়েছিলেন আবু বকর সিদ্দিক শিবলু।

সেটাই কাল হল। বাসার কাছে কোটবাড়ি রেললাইনের উপরে বাবা-ছেলে বসে গল্প করছিলেন। সেই অবস্থাতেই মাথায় এসে গুলি লাগলে লুটিয়ে পড়েন শিবলু। ছেলে ফারহান সিদ্দিক দৌড়ে এসে কাঁদতে কাঁদতে মাকে বলে, “মা, বাবা গুলি খেয়েছে।”

এলিট পেইন্টের সহকারী হিসাবরক্ষক শিবলু (৩৬) আগারগাঁও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালে চারদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ২৪ জুলাই মারা যান।

শিবলু ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার ইয়াকুবপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ চাঁনপুর এলাকার ওছি উদ্দিন ভূঞা বাড়ির আবুল হাসেমের ছেলে। সাত ভাই-বোনের মধ্যে শিবলু চতুর্থ।

দুই সন্তানের জনক শিবলু চাকরির পাশাপাশি দি ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস্ অব বাংলাদেশ-আইসিএমএবির শিক্ষার্থী ছিলেন।

ছেলে ফারহান সিদ্দিক উত্তরার একটি মাদরাসায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। ছোট মেয়ে নুসাইবা সিদ্দিকের বয়স নয় মাস। পরিবার নিয়ে উত্তরার আব্দুল্লাহপুর কোটবাড়ি রেলগেইট এলাকার একটি ভবনের চারতলায় বসবাস করতেন শিবলু।

ঘটনার দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে স্ত্রী মারজাহান আক্তার রিমু বলেন, “কর্মস্থল বন্ধ থাকায় সারাদিন বাসায় ছিলেন শিবলু। ঘরে কয়েকদিন বন্দি থাকায় ছেলে ফরহান বিরক্ত করছিল বাইরে যাওয়ার জন্য। বিকালের দিকে বাবা ছেলেকে নিয়ে বের হন। তখন আমি বলে দেই, ফেরার সময় যেন শশা নিয়ে আসে।

“বাবা-ছেলে বাসার কাছেই রেললাইনের উপর বসে কথা বলছিলো। এ সময় হঠাৎ চারপাশে গোলাগুলির শব্দ হতে থাকে। তখন ছেলেকে নিয়ে রেললাইন থেকে উঠে পড়ছিলেন। ঠিক তখনি, একটা গুলি এসে শিবলুর মাথার ডান পাশে লাগে। আর তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।”

রিমু বলেন, “তখন ফারহান কান্না করতে করতে দৌড়াতে দৌড়াতে বাসায় আসে। এসে আমাকে বলে, ‘মা, বাবা গুলি খেয়েছে। রাস্তায় পড়ে গেছে।”

“আমি তখন দ্রুত বাসা থেকে নেমে ঘটনাস্থলে যাই। গিয়ে জানতে পারি, স্থানীয়রা আমার স্বামীকে পাশের একটি হাসপাতালে নিয়ে গেছে। এরপর আর জ্ঞান ফিরেনি শিবলুর। হাসপাতাল পরিবর্তন করে আগারগাঁও নিউরো সায়েন্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই চারদিন পর মারা যান।”

রিমু জানান, শিবলুকে তিনি ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন। তাদের নয় বছরের সংসার।

এখন দুই সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত রিমু সন্তানদের লেখাপড়া ও সংসার চালাতে সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন।

শিবলুর বড় ভাই আবদুল হাকিম বাবলু ইয়াকুবপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক।

তিনি বলেন, “পড়াশোনা ও কাজের সুবাদে শিবলু ১২ বছর ধরেই ঢাকায় ছিল। চার বছর আগে উত্তরার ৮ নম্বর সেক্টরে বাসা নেয়। আইসিএমএবি’র দুই হাজার মার্কের কোর্সের মধ্যে ১৪০০ মার্ক কমপ্লিট হয়েছিল।”

ভাই গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে ফেনী থেকে সেদিন রাতেই ঢাকায় ছুটে যান বাবলু। চার ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয় শিবলুকে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই শিবলুর জ্ঞান ছিল না।

অবস্থা খারাপ হতে থাকলে ২৩ জুলাই তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। ২৪ জুলাই শিবলু মারা যান। আর ২৫ জুলাই রাতে গ্রামের বাড়িতে তাকে দাফন করা হয়।

আবদুল হাকিম বাবলু বলছিলেন, “ঘটনার দিন উত্তরা পূর্ব থানায় সংঘর্ষ হচ্ছিল। কিন্তু শিবলু গুলিবিদ্ধ হন দক্ষিণখান থানা এলাকায়। দুই থানাতেই আমরা গিয়েছি। কিন্তু কোনো থানাই মামলা নেয়নি। পরে ময়নাতদন্ত ছাড়াই ভাইকে দাফন করি।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *