শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর যা ঘটছে ভারতে!

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর ভারত কূটনৈতিকভাবে অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতিতে পড়ে গেছে। নয়াদিল্লিতে অবস্থান করছেন শেখ হাসিনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সোমবার (৫ আগস্ট) রাতে ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ে নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। এতে নয়াদিল্লির জন্য ব্যাপক কৌশলগত প্রভাব পড়েছে। এদিকে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর আজ মঙ্গলবার একই ইস্যুতে সর্বদলীয় বৈঠকে নিজ দেশের আইনপ্রণেতাদের ব্রিফ করেন। তিনি বলেন, পদত্যাগের পর শেখ হাসিনাকে এখন ভারতে সাময়িকভাবে থাকতে দেয়া হয়েছে। তাই নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনাকে সময় দেয়ার কথা জানিয়েছে ভারত সরকার। আজ ৬ আগস্ট সকালে পার্লামেন্টে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠক করে ভারত। খবর এনডিটিভির।

শেখ হাসিনা ভারতে: বিক্ষোভ-সহিংসতার মুখে ঢাকা থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর শেখ হাসিনাকে বহনকারী হেলিকপ্টার নয়াদিল্লির হিন্দন বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করে। রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে আজ যুক্তরাজ্যে উড়াল দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তার। তবে যুক্তরাজ্য তাকে আশ্রয় দিয়েছে কিনা সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। তাই যুক্তরাজ্য তাকে সবুজ সংকেত না দিলে কী হবে তা পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশের পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়ায় লন্ডন শুধুমাত্র জাতিসংঘের নেতৃত্বে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে, কিন্তু আশ্রয় ইস্যুতে কোন মন্তব্য করেনি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে শেখ হাসিনা ভারতে থাকবেন নাকি অন্য গন্তব্য খুঁজবেন। এ অবস্থায় ভারত একটি কূটনৈতিক সংশয়ের মুখোমুখি। ক্ষমতাচ্যুত নেতাকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেয়ার বিষয়টি দেখতে চায় না নয়াদিল্লি কারণ এতে বাংলাদেশের নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে প্রতিবেশী দেশটির দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে পরবর্তীতে জটিল হয়ে উঠতে পারে।

ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনার দীর্ঘ সুসম্পর্কের ইতিহাসও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনেক আগে, ১৯৭৫ সালের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের ১৮ সদস্যকে হত্যার পর ইন্দিরা গান্ধী সরকার শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছিল। তাই এই মুহুর্তে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে ত্যাগ করাও সহজ সিদ্ধান্ত হবে না নয়াদিল্লির জন্য।

বন্ধু যখন ক্ষমতা হারায়: শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ নয়াদিল্লির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। ২০০৯ সাল থেকে তার টানা তিন মেয়াদে নয়াদিল্লি-ঢাকা সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে জোরালো হয়েছিল। সড়ক ও রেল যোগাযোগ থেকে শুরু করে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সবক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক এই সময়ে দৃঢ় হয়। হাসিনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ যখন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছিল, তখনও ভারতের প্রতিক্রিয়া ছিল যে এটি বন্ধুপ্রতীম দেশটির একটি ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’। ৭৬ বছর বয়সী এই নেতাকে ক্ষমতাচ্যুত করায় ভারতকে এখন ঢাকা নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে হবে।

বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান গতকাল বলেন, দেশ পরিচালনার জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। বাংলাদেশে বিক্ষোভের সমর্থনকারী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং জামায়াতে ইসলামী নতুন সরকারে কী ভূমিকা পালন করবে তা স্পষ্ট নয়। এই দুটি দলই ভারতের বন্ধু নয়। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মেয়াদকালে দিল্লি-ঢাকা সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর খালেদা জিয়া কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছেন। অতীতে ভারতবিরোধী অবস্থানকে নির্বাচনী তকমা হিসেবে ব্যবহার করেছেন খালেদা জিয়া। এবং অভিযোগ করেন নয়াদিল্লি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে। অন্যদিকে জামায়াতের পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাই ভারত ঘনিষ্ঠভাবে ঢাকার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবে।

শরণার্থী ঢলের ভয়

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার বিক্ষিপ্ত ঘটনার মধ্যে ভারতের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয় হলো নৃশংসতা থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীরা আশ্রয় নিতে পারে প্রতিবেশী দেশটিতে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চার হাজার ৯৬ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

ভারতে, বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব এবং পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশি উদ্বাস্তুদের আগমন একটি মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনার পর, ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী (বিএসএফ) আন্তর্জাতিক সীমান্তে উচ্চ সতর্কতা জারি করেছে। ত্রিপুরার টিপরা মোথার নেতা প্রদ্যোত কিশোর মাণিক্য দেববর্মা বলেন, তিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং তাকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে কোনও অনুপ্রবেশের অনুমতি দেয়া হবে না।

একটি উত্তাল প্রতিবেশী

ভারতের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ঢাকা উত্তাল ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় কে পরবর্তীতে ক্ষমতার মসনদে বসবে সেটা দেখার বিষয় ভারতের।

জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপি ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বি চীনের সঙ্গে আরও বেশি জোটবদ্ধ হতে পারে। সেই সময় ঘোলাটে পানিতে মাছ শিকারের কোন সুযোগ হাতছাড়া করবে না বেইজিং। এটি এই অঞ্চলে ভারতের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির জন্য মোটেও সুখবর নয়।

বিগত কয়েক বছরে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতে অস্থিরতা, সহিংসতা দেখা গেছে, তা শ্রীলঙ্কা হোক বা মিয়ানমার হোক বা আফগানিস্তান হোক আর এখন বাংলাদেশ।

চীন এবং পাকিস্তান এক ধরনের জোট গঠন করেছে এবং কিছু দেশে নতুন সরকার ব্যবস্থা এনে দিয়েছে, উদাহরণস্বরূপ মালদ্বীপ। জানা গেছে তারা (বিএনপি-জামায়াত) নয়াদিল্লির চেয়ে এই ব্লকের সঙ্গে বেশি জড়িত। আফগানিস্তানে কট্টরপন্থী তালেবান ক্ষমতায় আসার পর পূর্ববর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের যে দৃঢ় সম্পর্ক ছিল তা ভেঙে যায়।
এর মধ্যে, ঢাকার সঙ্গে নয়াদিল্লির যে কূটনৈতিক সুসম্পর্ক ছিল তা গতকাল পাল্টে গেছে। ভারতকে এখন এই নতুন সংকট মোকাবিলায় নতুনভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *