ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। এর পরই বদলে গেছে বাংলাদেশের রাজনীতির নানা হিসাব-নিকাশ। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে দুর্নীতির মামলায় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিচার চলছিল ঢাকার একটি আদালতে। সেই বিচার শেষ হওয়ার আগেই ক্ষমতা ছাড়তে হয় প্রধানমন্ত্রীকে। আর ড. ইউনূস বাংলাদেশের সেনাসমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান নিযুক্ত হন। সামনের দিনগুলোয় দেশ চালাতে গিয়ে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী নতুন সরকারকে প্রধান তিনটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বলে এক বিশ্লেষণে দাবি করেছে ব্রিটিশ সাপ্তাহিক দ্য ইকোনমিস্ট।
ইকোনমিস্টের বিশ্লেষণে বলা হয়- ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে চলতে থাকা দুর্নীতির মামলায় গত ৫ আগস্ট রায় হওয়ার কথা ছিল এবং তার যাবজ্জীবন কারাদ- পর্যন্ত হতে পারত। তবে বিচারের বদলে তিনি এখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান পদে আসীন হয়েছেন। এরই মধ্যে শেখ হাসিনা সরকার
পতনের পর দেশের প্রশাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এ অবস্থায় ইউনূসকে কঠিন সময় পার করতে হবে এবং শক্ত হাতে দেশের হাল ধরতে হবে।
বাংলাদেশে সাংবিধানিক শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করাটা ইউনূসের জন্য কঠিন হবে। কারণ, শেখ হাসিনার আকস্মিক দেশত্যাগের ফলে দেশে নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। তার দল আওয়ামী লীগ জনগণের কাছে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। অন্যদিকে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেত্রী ৭৮ বছর বয়সী খালেদা জিয়া। তিনি বর্তমানে অসুস্থ ও শেখ হাসিনার আমলে তার দল বিএনপি একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ইসলামপন্থি দলগুলো আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তারাও এখন নেতৃত্বে আসতে চাইতে পারে। তবে এই চ্যালেঞ্জটি
আরও বড়। কেননা, বাংলাদেশ এখন চীন, ভারত এবং পশ্চিমাদের মধ্যে একটি ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেনাবাহিনীর সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবকে আশা জাগানিয়া বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রথম চ্যালেঞ্জ : দ্য ইকোনমিস্টের মতে, ৮ আগস্ট শপথ নেওয়ার পর ড. ইউনূসের প্রথম কাজ হবে দেশে আবার শান্তিপূর্ণ রাজনীতি ফিরিয়ে আনা। দেশের সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার চেয়ে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। জুলাই মাসে শুরু হওয়া বিক্ষোভ ঘিরে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়। আন্দোলনের মুখে কোটা সংস্কারের পক্ষে রায় দেন আদালত। তবে এত রক্তপাত ও বহু বছর ধরে চলা শেখ হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের হতাশাকে উসকে দিয়েছিল। চলতি সপ্তাহের শুরুতে তার বাসভবনে ভাঙচুর এবং পুলিশ স্টেশন ও আওয়ামী লীগ মন্ত্রীদের বাড়িতে হামলার ঘটনাগুলো প্রতিবাদকারীদের ক্ষোভেরই প্রতিফলন। অব্যাহত এই অশান্তির ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে ৭ আগস্ট দেশবাসীকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ড. ইউনূস।
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ : বাংলাদেশের রাজনীতির পুনর্গঠন করা হবে ড. ইউনূসের পরবর্তী কাজ। এ জন্য শুধু দ্রুত নতুন নির্বাচন দেওয়াই যথেষ্ট নয়। তাকে দেশের আদালত ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব কমাতে হবে। একই সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক দলগুলোকে সংগঠিত হওয়ার জন্য সময় ও সুযোগ দিতে হবে। এই পদক্ষেপগুলো ছাড়া একটি নতুন নির্বাচন সহজেই ইসলামপন্থি গোষ্ঠী বা একটি পুনর্গঠিত বিএনপির পক্ষে যেতে পারে। তবে এই শক্তিগুলোও দলকেন্দ্রিতায় ভুগছে।
তৃতীয় চ্যালেঞ্জ : ড. ইউনূসের জন্য তৃতীয় বড় চ্যালেঞ্জ হলো একটি জটিল ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্র তৈরি করা। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী দেশ ভারত এ পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হবে। গত এক দশকে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় ভারত শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে বাণিজ্য, জ্বালানি ও সামরিক সম্পর্ক সম্প্রসারিত করেছে। নির্বাসনে যাওয়া শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার কারণে অনেক বাংলাদেশির মনে ভারত বিরোধিতা আরও বাড়বে। এ ছাড়া বাংলাদেশে অবস্থান করা আনুমানিক ১০ হাজার ভারতীয় নাগরিক এবং ১ কোটি ৪০ লাখ হিন্দু সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় সহায়তা করার জন্য চাপে রয়েছে দিল্লি। সামনের দিনগুলোতে আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তার জন্য বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং যেকোনো উত্তরসূরি শেখ হাসিনার চেয়েও বেশি চীনের দিকে ঝুঁকতে পারেন- এমন আশঙ্কাই বেশি।
Leave a Reply