ঝুঁকির মধ্যে পড়বে কি বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানের বিপ্লব?

উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়া। আরব বসন্তের সূতিকাগার। সিদি বাউজিদ শহরের বাসিন্দা তারেক আল তাইয়িব মোহাম্মদ বুআজিজি জীবিকা নির্বাহ করতেন রাস্তায় ফল বিক্রি করে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ঘুস দিতে দিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। মাসে আয় ছিল সাকল্যে ১৪০ ডলারের সমপরিমাণ (২০১১ সালের বিনিময় হারে)। এর বড় একটি অংশ নিয়ে নিত পুলিশ। অর্থ দিতে অস্বীকৃতি জানালে মামলা, নির্যাতন আর হেনস্তা। সহ্য করতে না পেরে ২০১১ সালের ৪ জানুয়ারি স্থানীয় গভর্নর অফিসে অভিযোগ নিয়ে যান তিনি। যদিও গভর্নর সেদিন তার সঙ্গে দেখাই করেননি। ক্ষুব্ধ-অপমানিত মোহাম্মদ বুআজিজি সেদিনই ব্যস্ত রাস্তায় উপস্থিত জনতার সামনে গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। আগুনের লেলিহান শিখা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যেও চিৎকার করে অভিযোগ করতে থাকেন, ‘আমার বাঁচার কোনো পথ খোলা রাখা হয়নি।’

বুআজিজির মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে তিউনিসিয়ার জনগণ। তাদের ক্ষোভকে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ দেয় খাদ্যের উচ্চ মূল্যস্ফীতি, দুর্নীতি ও ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব। দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বেন আলির পদত্যাগের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে মানুষ। ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে দখল করে রাখা ক্ষমতার মসনদ ছাড়তে বাধ্য হন বেন আলি। পালিয়ে যান দেশ ছেড়ে। তিউনিসিয়ায় শুরু হওয়া বিক্ষোভের এ ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে পুরো আরব বিশ্বে। গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনে নামে বাহরাইন, মিসর, লিবিয়া, সিরিয়া ও ইয়েমেনের মানুষ, যা বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায় ‘আরব বসন্ত’ নামে। ক্ষমতাচ্যুত হয় বেশ কয়েকটি দেশের শাসক। আর এ আরব বসন্তের সূচনাকারী তিউনিসিয়ার অভ্যুত্থানটি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায় জেসমিন রেভল্যুশন বা জেসমিন বিপ্লব নামে।

দিনাজপুরে পুলিশের ছোড়া টিয়ার শেলে আরও এক আহত শিক্ষার্থীর মৃত্যু
তিউনিসিয়ার মতো দীর্ঘদিনের শাসককে ক্ষমতা ছেড়ে দেশত্যাগ করে পালাতে বাধ্য করেছে বাংলাদেশের মানুষও। এখানেও তিউনিসিয়ার মতোই উচ্চ মূল্যস্ফীতি, দুর্নীতি ও বৈষম্যে ক্ষিপ্ত মানুষের মধ্যে অভ্যুত্থানের স্ফুলিঙ্গ তৈরিতে বড় অনুঘটকের কাজ করেছিল মর্মান্তিক কিছু মৃত্যুর ঘটনা।

২০২৪ সালের ১৬ জুলাই। বাংলাদেশ সময় বেলা আড়াইটা। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ (২৫) গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে এক পুলিশ সদস্যকে আবু সাইদকে লক্ষ্য করে পর পর চার রাউন্ড গুলি করতে দেখা যায়। ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের পাশে সারা দেশের মানুষ রাজপথে নেমে আসে। এক পর্যায়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের বিক্ষোভে। এ বিক্ষোভ গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিলে ৫ আগস্ট ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাখা ক্ষমতা ত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

শাসক দীর্ঘদিন কুক্ষিগত করে রাখা ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর তিউনিসিয়ায় রাষ্ট্রব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল। সে সময় বেন আলি সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ ঘানৌচির নেতৃত্বে তার গঠন করা অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা সেভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। প্রায় প্রতিদিনই বিক্ষোভে নামছিল সাধারণ মানুষ। এক মাসের মধ্যেই সে সরকারেরও পতন হয়। কিন্তু সাইদ এসেবসির নেতৃত্বে গঠিত নতুন অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভাও সেভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। পরে ওই বছরের অক্টোবরে দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তাতে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে ইসলামপন্থী এন্নাদা পার্টি। কিন্তু পরে দলটির গৃহীত বিভিন্ন এজেন্ডা শেষ পর্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল, পশ্চাৎমুখী হিসেবে দেখা দিতে লাগল। দুই বছরের মাথায় আবারো শুরু হলো প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। এরপর ২০১৩ সালের শেষ নাগাদ আবারো রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে দ্রুত মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় এন্নাদা পার্টির সরকার। অস্থিরতার মধ্যে ২০১৪ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করেন নতুন প্রেসিডেন্ট সাইদ এসেবসি। ২০১৯ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ পদে আসীন ছিলেন তিনি। কিন্তু রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক অস্থিতিশীলতায় তিনবার প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন করতে হয়েছে তাকেও। যদিও টালমাটাল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা, আর্থিক দুরবস্থা, বেকারত্বসহ সংকটগুলো থেকে আর বের হতে পারেনি তিউনিসিয়া। সাইদ এসেবসির মৃত্যুর দুই বছরের মাথায় ২০২১ সালে আবারো সাংবিধানিক সংকট তীব্র হয়ে দেখা দেয় দেশটিতে। সে সময় বেশকিছু মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তাদের বরখাস্ত, কারফিউ জারি ও পার্লামেন্ট স্থগিত করার মতো সিদ্ধান্ত নেন দেশটির প্রেসিডেন্ট কাইস সাইদ। এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধানের কিছু অংশ স্থগিত করার মাধ্যমে নিজের ক্ষমতাকেও জোরদার করেন, যাকে দেশটির রাজনৈতিক দলগুলো আখ্যা দিচ্ছে সাংবিধানিক অভ্যুত্থান হিসেবে। এখনো তিউনিসিয়ার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসেনি। মূল্যস্ফীতি, খাদ্য ঘাটতি ও উচ্চ বেকারত্বসহ মারাত্মক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে দেশটিকে।

তিউনিসিয়ায় জনতার অভ্যুত্থান সফল না হওয়ার কয়েকটি কারণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে করছেন রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা। তারা বলছেন, সেখানে অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে দেয়ার পেছনে প্রধানত চারটি বিষয় কাজ করেছে। এগুলো হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সর্বজনগ্রহণযোগ্যতা না থাকা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোকে ঠিকমতো মোকাবেলা করতে না পারা এবং সর্বোপরি এগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো ঠিকমতো করতে না পারা। এগুলোর অনুপস্থিতিতে অভ্যুত্থানের পর এক দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরতে পারেনি তিউনিসিয়া।

বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা সরকারের জন্যও এ চারটি বিষয়কেই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এখন এ চারটি বিষয় নিশ্চিত করার ওপর জোর দিতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশেও তিউনিসিয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার জোর আশঙ্কা রয়েছে।

তবে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গ্রহণযোগ্যতা বাংলাদেশের জন্য এসব চ্যালেঞ্জ অতিক্রমকে অনেকটাই সহজ করে দেবে বলে প্রত্যাশা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীম উদ্দীন খানের। তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে উনার সম্পর্ক শক্তিশালী,৷ উনার ক্ষেত্রে যে সুযোগ রয়েছে, তিউনিসিয়ার ক্ষেত্রে তা ছিল না। সুতরাং এখনই বলা যাবে না বিপ্লব ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে কিনা। আমাদের এখানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদেরও প্রতিনিধি রয়েছে। তাদের রাষ্ট্র সংস্কারেরও একটা কমিটমেন্ট আছে। তারা যে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী ছিল; তা না। তবে এখন সেটা একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। এটা তাদের কমিটমেন্টের ওপর নির্ভর করবে। এখানে খ্যাতি আছে। অর্থের প্রলোভন আছে। তারা সেটাকে কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবাই এ প্রলোভনে পড়ে ধ্বংস হয়েছে।’

শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতাচ্যুত হন, দেশের অর্থনীতি তখন নাজুক পরিস্থিতিতে। সরকারি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকায়। গত দেড় দশকে এ ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৬ গুণেরও বেশি। দেশের রিজার্ভের অবস্থাও খুব নাজুক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বিপিএম৬ পদ্ধতিতে হিসাবায়নের পর গত ৩১ জুলাই দেশের রিজার্ভ নেমে এসেছে ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলারে। এর মধ্যে ব্যবহারযোগ্য বা নিট রিজার্ভ ১৫ বিলিয়ন ডলারেরও কম। আইএমএফের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশ ও সমজাতীয় অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের রিজার্ভই সবচেয়ে বেশি কমেছে।

এ মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে বড় একটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। এর সঙ্গে সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঠিক করতে না পারলে ব্যবসা ও অর্থনৈতিক অবস্থা বাধাগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা তাদের। তারা বলছেন, কারখানাগুলো যাতে ভালোভাবে চলতে পারে, আমদানি-রফতানি যাতে সৃশৃঙ্খলভাবে চলতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে দেশে প্রশাসন ব্যবস্থা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও এখন বড় ধরনের অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় প্রায় প্রতিটি মহল্লায় এখন প্রতিদিন রাত জেগে এলাকা পাহারা দিচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। অন্যদিকে সবার মধ্যে পুলিশসহ প্রশাসনের সর্বত্র সংস্কারের জোর দাবিও উঠছে।

বর্তমান নাজুক অবস্থায় দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতিকে সতর্কতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে সামাল দিতে না পারলে তা তিউনিসিয়ার জেসমিন বিপ্লবের মতোই বেহাত হয়ে পড়ার জোর আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাপক মাত্রায় সংস্কার ও জনগণকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে না পারলে বাংলাদেশে ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানও জেসমিন বিপ্লবের মতো ভেস্তে যাওয়ার জোর আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশের টেকসই উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিতের ওপর জোর দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোয় দুর্নীতি প্রোথিত হয়ে পড়েছে। বেশির ভাগ সরকারি সংস্থায় একই পরিস্থিতি। এর জন্য প্রশাসনিক সংস্কার প্রয়োজন। এখানে ব্যক্তি বদল করে হবে না। সিস্টেমকে এমনভাবে পরিবর্তন করতে হবে যাতে কেউ আর দুর্নীতি করতে না পারে। এর জন্য স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতিগ্রস্তের যথাযথ শাস্তি নির্ধারণ করতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়ার সুযোগ দিতে হবে। আইনি বাধাগুলো কীভাবে মোকাবেলা করা যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ আইনগত, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনাগত দিকগুলোয় পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে।’

প্রবীণ রাজনীতিবিদরা মনে করছেন, বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে এর সঙ্গে ব্যাপক জনসাধারণের সম্পৃক্ততা আরো বাড়াতে হবে।

বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য করণীয় সম্পর্কে প্রবীণ বুদ্ধিজীবী এবং জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর বলেন, ‘বর্তমান অবস্থা থেকে সম্পূর্ণরূপে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন হবে রাষ্ট্রকাঠামোর পরিবর্তন। এ পরিবর্তন তো হলো বিপ্লব। এ বিপ্লবের উপযোগী রাজনৈতিক সংগঠন যতক্ষণ না পর্যন্ত গড়ে উঠছে; শক্তিশালী হচ্ছে; ব্যাপক জনগণকে নিজের সঙ্গে নিতে পারছে; ততদিন পর্যন্ত কোনো আশা নেই। তবে জনগণের যে অবস্থা তাতে মানুষ বসে থাকবে না। এ সংগ্রাম চলবে। শেষ পর্যন্ত এ দেশে যদি পরিবর্তন হয়, তাহলে আরো ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হতে হবে। না হলে এ অবস্থাই ঘুরেফিরে বারবার আসবে।’

বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিকড় প্রোথিত রয়েছে ‘গুরুবার আড্ডা’ নামে একটি পাঠচক্রে। ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এটি শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মাহফুজ আলম। গুরুবার আড্ডার ধারণা ছিল ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক পাঠচক্রের মাধ্যমে সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি ও রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে বোঝাপড়া নিশ্চিত করা।

২০২৩ সালে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের ছাত্র অধিকার পরিষদের আর্থিক অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠলে দলটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতাকর্মীরা একযোগে দল থেকে পদত্যাগ করে। পদত্যাগ করা কর্মী ও গুরুবার আড্ডার পাঠচক্রের শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে রাজনৈতিক প্লাটফর্ম ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি’। গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তিতে যোগ দেয়া নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পান খুব দ্রুতই। আন্দোলনের সমন্বয়কদের অনেকেই এ গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তির সদস্য।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাহফুজ আলম বলেন, ‘রাজনৈতিক পরিসর তৈরি, ব্যক্তিকে রাজনৈতিক করে তোলা, বিরাজনীতিকরণের বিরুদ্ধে অবস্থান করা ছিল আমাদের পাঠচক্রের মূল বিষয়। আন্দোলনে আমাদের কাজ ছিল মূলত পরামর্শকের ভূমিকা পালন করা। আমাদের আশপাশের অভিজ্ঞতা থেকে, ইতিহাস থেকে আমরা আন্দোলনকারীদের পরামর্শ দিতাম। তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা গ্রহণ করত। আমরা শুরুতেই এক দফায় যাওয়ার পক্ষে ছিলাম না। তখন আমরা অসহযোগের পরামর্শ দিলাম। আমাদের পরামর্শ ছিল এ অসহযোগ গান্ধীবাদী অসহযোগ হবে না। বরং তা হবে একাত্তরের অসহযোগের মতো। তখন সবাই আমাদের এক দফায় যাওয়ার জন্য বলছিল। তখন আমাদের মনে হলো আরো বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে আন্দোলনে যুক্ত করতে হবে। বদরুদ্দীন উমর তখন এক সংবাদমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে গণ-অভ্যুত্থানের কথা বললেন। আমাদের মনে হলো, এটিকে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ দিতে হলে আরো বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে যুক্ত করতে হবে। অসহযোগ ছিল আমাদের অভ্যুত্থানের আগের কর্মকাণ্ড।’

উৎসঃ বণিকবার্তা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *