বগুড়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী নুসরাত জাহান জেরিন মারা যাননি। পুলিশের গুলিতে ওই ছাত্রী প্রাণ হারিয়ে লুটিয়ে পড়ার ১৮ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিও দেখে অনেকে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। জেরিন জানিয়েছেন, তিনি সুস্থভাবে বেঁচে আছেন।
ভিডিওটি বগুড়ার সাতমাথা মোড় এলাকার বলে বার্তা সংস্থা এএফপির ফ্যাক্ট-চেকিং এডিটর কদরুদ্দীন শিশির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
জানা গেছে, ঘটনাটি বগুড়ার সাতমাথা বীরশ্রেষ্ঠ স্কয়ার–সংলগ্ন ট্রাফিক আইল্যান্ড এলাকার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালের ভিডিও এটি। বগুড়ায় এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া কয়েকজনকে ভিডিওটি দেখানো হলে তারা স্থানটির বিষয়ে নিশ্চিত করেন। আর স্থানীয় লোকজন বলছেন, ভিডিওটি ঘটনাস্থলের পাশে এসআর ট্রাভেলসের কাউন্টারের সামনে থেকে ধারণ করা হয়েছে।
গত ১৮ জুলাইয়ের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, হেলমেট ও পুলিশের ভেস্ট পরা ব্যক্তিরা বগুড়া জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) এবং ৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) বগুড়ার সদস্য। গুলির শব্দ ও পরপরই মেয়েটি লুটিয়ে পড়ায় ডিবির কয়েকজন সদস্য সেখানে যান। এ সময় স্কুলের পোশাক পরা একজন আন্দোলকারী তাকে উদ্ধারে এগিয়ে এলে পুলিশের একাধিক সদস্য লাঠি হাতে তাকে তাড়া করেন।
এ বিষয়ে ডিবি বগুড়ার পরিদর্শক মুস্তাফিজ হাসান জানান, গত ১৮ জুলাই সাতমাথা এলাকায় তিনি ছাড়াও ডিবি, সদর থানা ও এপিবিএনের সদস্যরা দায়িত্বে ছিলেন। ভিডিওটিতে যে মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে, ওই মেয়ে ওই সময়ে গুলিবিদ্ধ হননি। সম্ভবত তিনি কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় অসুস্থ বোধ করছিলেন। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে পানি পান করায়। মিনিট পাঁচেক পর তিনি নিজে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। পরে অন্য কোথাও মেয়েটি বুলেটবিদ্ধ হয়েছেন কি না, তা তিনি জানেন না।
জানা যায়, মেয়েটির নাম নুসরাত জাহান (জেরিন)। পড়াশোনা করেন রাজধানীর বেসরকারি শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির সমাজবিজ্ঞান ও নৃতত্ত্ব বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে।
বগুড়ার উপশহর এলাকার বাসিন্দা নুসরাত। তিনি গণমাধ্যমকে জানান, ১৮ জুলাই মিছিলে যোগ দেয়ার পর তিনি সাতমাথায় পুলিশের হামলার শিকার হন। চারটি রাবার বুলেট বিদ্ধ হয় তার শরীরে। প্রথমে তাকে বগুড়ার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে এবং পরে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পুলিশের ভয়ে তিনি ওই সন্ধ্যায় হাসপাতাল ছেড়ে বাড়িতে চলে আসেন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দেয়ার বিষয়ে নুসরাত জাহান বলেন, ‘রংপুরে আবু সাঈদ হত্যার পর আর ঘরে বসে থাকতে পারলাম না। মা–বাবার উদ্দেশে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে গত ১৮ জুলাই সকাল নয়টার দিকে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বের হই। দত্তবাড়ি থেকে সাতমাথার দিকে ছাত্রদের বিশাল মিছিল বের হয়। সদর থানার সামনে পুলিশ মিছিলে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। সাতমাথায় পৌঁছানোর আগে কয়েকটি কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। মিছিল নিয়ে আমরা সাতমাথায় পৌঁছামাত্র পুলিশ শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। মিছিল থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে প্রথমে জিলা স্কুলে আশ্রয় নিই। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাতমাথায় যেখানে ভিডিওটা করা, সেখানে পৌঁছালে একজন পুলিশ কর্মকর্তা খুব বাজে ভাষায় গালমন্দ করেন। পুলিশ ছাত্রদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে তেড়ে আসে। এ সময় একটি রাবার বুলেট ঊরুতে লাগলে ব্যথায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ পর সুস্থ বোধ করলে আবারও আন্দোলনে যোগ দিই। এ সময় পর পর কয়েকটি রাবার বুলেট পায়ে এসে লাগলে আহত হই। প্রথমে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে এবং পরে সেখান থেকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। খবর পেয়ে পরিবারের লোকজন আসেন।’
তিনি আরও জানান, হাসপাতাল থেকে বাড়িতে পৌঁছার পর রাতে তিনি জানতে পারেন যে তার মৃত্যুর খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক বন্ধু তাকে কল করেন। তিনি তাদের নিজের বেঁচে থাকার কথা জানান।
Leave a Reply