সরকার পতনের ঘটনাকে অনেকটাই হোমারের ইলিয়াডের সাথে তুলনা করা যায়। দ্বিগবিজয়ী সেই মহাকাব্যে খুবই তুচ্ছ একটি কারণে ট্রয় নগরের পতন ঘটে। তবে সেই পতন খুব সহজে ঘটেনি, দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ঘটেছে। পতনটি ঘটাতে সময় এবং রক্ত দুটোই ঝরাতে হয়েছে অকাতরে। বাংলাদেশেও আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটেছে অজস্র গুম, খুন এবং অত্যাচারের বিনিময়।
দেশে বর্তমানে চলছে পরিবর্তনের জোয়ার। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে দৃশ্যমান পরিবর্তন। দেশের খেলাধুলায় যেন সেই পরিবর্তন ফুটে উঠছে আরও বেশি করে। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দল পাকিস্তানের মাটিতে ঐতিহাসিক একটি টেস্ট ম্যাচ জিতে ফেলেছে। এবং দ্বিতীয় টেস্টের চতুর্থ দিনের খেলা চলছে এখন।
যেখানে বাংলাদেশ দল পাকিস্তানের তুলনায় রয়েছে বেশ সুবিধানে জনক অবস্থায়। বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্রীড়া মন্ত্রী আসিফ মাহমুদ, বয়সের হিসাবে সবে ২৬ এ পর্দাপণ করলেন। নতুনত্বের অন্বেষণ এবং তারুণ্যের সততা দুটোই ভেসে উঠে তার মুখ মন্ডলে। ক্রীড়া জগতে বরাবরের মতোই আমরা টুকটাক সাফল্যে সন্তুষ্ট থাকা রপ্ত করেছিলাম।
তাছাড়া উপায় হাতে ছিল কি? বিসিবির কথাই যদি ধরি, দেশের একমাত্র লাভজনক ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান এটি। যাদের সরকারের কাছ থেকে অনুদান নেওয়া লাগে না। অর্থাৎ বাংলাদেশের ক্রীড়া জগতের রোল মডেল বলা যায় বিসিবিকে। তবুও বিসিবির অন্তর্নিহিত দুর্নীতি এবং অনৈতিকতা তো কারো কাছেই গোপন নেই। ঘরোয়া লীগে ফিক্সিং থেকে শুরু করে অযোগ্যদের সুযোগ দেওয়া। বিভিন্ন দল মেধার ভিত্তিতে নয় বরঞ্চ স্বজন প্রীতির মধ্য দিয়ে গঠন করা।
এই সবকিছু দেশের অন্যান্য ফেডারেশনের মতো বিসিবিতেও দৃশ্যমান। নতুন ক্রীড়া মন্ত্রী যেহেতু সত্যের পথে অবিচল থাকার প্রজ্ঞায় ক্ষমতায় বসেছেন। তাই তার থেকে প্রত্যাশা থাকবে আকাশচুম্বি। প্রত্যাশা পূরণে তার কার্যকলাপও অবশ্য লক্ষণীয়। তিনি পুরো বিসিবির কাঠামো পাল্টে দিয়েছেন। ফারুক আহমেদকে সভাপতির আসনে উপনীত করে প্রথমবারের মতো কোনো ক্রিকেটারের হাতে এই সম্মানজনক পদ দিয়েছেন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাবৃন্দের মূল লক্ষই নিয়ন্ত্রান্ত্রিক এমন সব পরিবর্তন আনা যা তাদের দায়িত্বকালীন সময়ের পরেও ফলপ্রসূ হবে। বর্তমানে আসিফ মাহমুদ ক্রিকেট নিয়ে তিনটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিতে পারেন। যা একলাফে দেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে বহুদূর। দেশের ক্রিকেটের অন্যতম বড় সমস্যা প্রতিভাবান ক্রিকেটাররা অনেক ক্ষেত্রেই শীর্ষ পর্যায়ে আসার আগে ঝরে পড়ে। এর অন্যতম কারণ ঢাকা লীগের চিত্রনাট্য ম্যাচ।
লেখাটি পড়ে মনে হতে পারে চিত্রনাট্য ম্যাচ আবার কি? চিত্রনাট্য ম্যাচ হলো সেই ম্যাচগুলো যেগুলোর ফলাফল দল মাঠে নামার আগেই চূড়ান্ত হয়ে থাকে। ঢাকা প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিভাগে এই ধরনের ঘটনা একেবারেই বিরল নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় একই মালিকের তিনটি থেকে চারটি দল লীগে খেলছে। ঘটনাক্রমে সমীকরণ যদি এমন দাঁড়ায় একই মালিকের দুটি দল পরস্পর মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। একটি দল জিতলেও তাদের পরবর্তী রাউন্ডে উঠার সম্ভাবনা নেই।
তবে আরেকটি দলের সেই সম্ভাবনা বেশ ভালোভাবেই রয়েছে। তখনই সচরাচর ইচ্ছা করে ম্যাচ ছেড়ে দিতে হয় একটি দলকে। এছাড়াও ঢাকা দ্বিতীয় বিভাগে খেলা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ক্রিকেটার তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন স্পোর্টস আওয়ারকে। তিনি নিজের প্রথম ম্যাচে অদ্ভুত এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। ক্রীজে আসার পরক্ষণেই আম্পায়ার তাকে জানিয়ে দেন বল পায় লাগলেই এল বি ডব্লিউ দেওয়া হবে। বল কি লাইনে আছে কি নাই এটা দেখা হবে না।
এই কথা অবশ্য তাকে খুব একটা বিচলিত করতে পারেনি, কারণ ঢাকা লীগের এই সংস্কৃতি সম্পর্কে সবারই কম বেশি ধারণা রয়েছে। প্রতিভাবান ক্রিকেটাররা এভাবেই নানান স্তরে বাদ পড়ে যান, এছাড়াও এই ধরনের ক্রিকেট সংস্কৃতি থেকে উঠে আসা ক্রিকেটাররা নৈতিকভাবে আদর্শ হবেন না এটাই স্বাভাবিক। ক্রিকেটারদের নৈতিক হওয়ার পরামর্শ আমরা সবাই কমবেশি দিয়ে থাকি।
তবে তারা যে সংস্কৃতিতে বড় হচ্ছে এই পরিবেশে চাইলেও নৈতিক থাকা বড় কঠিন। অন্তবর্তীকালীন সরকারের তরুণ ক্রীড়ামন্ত্রী ঘরওয়ালীগের এই মাফিয়াদের চক্রটা ভেঙে দিতে পারলে এটি দেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাবে যোজন ব্যবধানে। এছাড়াও দেশের অন্যান্য বিভাগীয় লীগগুলোর অবস্থা খুবই বাজে। সিলেট লীগে একসময় রানাতুংগাদের মতো ক্রিকেটাররা খেলে গিয়েছিলেন।
সেই প্রতিযোগিতাপূর্ণ লীগেই এখন ১৪-১৫ বছর বয়সী শিশুদেরও খেলিয়ে দেওয়া হয়। ক্রিকেটার ওঠার মূল পাইপলাইনই আসবে দেশের কিছুটা পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলো থেকে। কারণ সেখানেই খেলাধুলার জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত মাঠ। অথচ সেখান থেকে ক্রিকেটার ওঠার পথ অনেকটাই যেন জোর করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দেশের ক্রিকেটে উন্নতি না হওয়ার আরেকটি বড় কারণ স্বজনপ্রীতি।
বিকেএসপি থেকে শুরু করে ঢাকা মেট্রো, জেলা পর্যায়ে থেকে শুরু করে বিভাগীয় পর্যায়ের নির্বাচন প্রক্রিয়া। সবকিছুতেই এই স্বজন প্রীতির কালি লেপিত আছে আষ্টেপৃষ্ঠে। এই স্বজনপ্রীতি জনিত সমস্যার সমাধান দেশের ক্রিকেটকে দিতে পারে আরো মূল্যবান সব রত্ন। দেশের ক্রিকেটে এতসব সমস্যার মূল কারণ বোর্ডে অযোগ্যদের প্রাধান্য। এবং এক ধরনের দায়িত্বহীন মনোভাব। দেশের ক্রিকেট আঙ্গনের শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্তকারীরা নিজেদের কাজের ব্যাপারে অনেকটাই দ্বিধাগ্রস্থ।
দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং পাইপলাইন শক্ত করা যেখানে তাদের মূল কাজ হওয়া উচিত। সেগুলো না করে বরঞ্চ তারা জাতীয় দলের বিভিন্ন পরিকল্পনায় জোরপূর্বক হস্তক্ষেপ করেন। যোগ্যদের এই দায়িত্বগুলো দেওয়া হলে তারা নিজেদের কাজের পরিধি সম্পর্কে থাকবেন অবগত। ফলে দেশের ক্রিকেটেও দেখা যাবে লক্ষণীয় উন্নতি।
Leave a Reply