আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশে নতুন পরিস্থিতিতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। চারদলীয় জোট প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজনীতির ময়দানে দীর্ঘদিনের বন্ধু হিসাবে পরিচিত এ দুটি দল এখন মুখোমুখি অবস্থানে। জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা নিয়ে মূলত তাদের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের জন্য ‘যৌক্তিক’ সময়ের কথা বললেও জামায়াতের অবস্থান ভিন্ন। জামায়াত তাড়াহুড়ো না করে সংস্কারের জন্য অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারকে পর্যাপ্ত সময় দিতে চায়। এসব ছাড়াও এখন আরও কিছু ভিন্ন ইস্যু এতে যোগ হয়েছে। চলছে নেতাদের বাহাস। দুই দল থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়েছে তারা এখন আর একই জোটে নেই।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগ মাঠে নেই। নেতাকর্মীরা হয় পালিয়েছেন, নয় আত্মগোপনে। আবার কেউ কেউ আটক হয়েছেন। তাই রাজনীতির মাঠে একধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। ফাঁকা জায়গায় একটি বড় শক্তি হিসাবে সামনে আসতে চাইছে জামায়াত। কিন্তু এতে ভোটের রাজনীতিতে বড় কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ, জামায়াতের যে ভোট ব্যাংক, তা খুব বেশি বাড়বে না। তারা আরও মনে করেন, বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করবে। তারা সহযোগিতা করছেনও। তবে নির্বাচনের জন্য ‘যৌক্তিক’ সময়ের কথা বলা বা রোডম্যাপ চাওয়া দোষের কিছু নয়। এটি চাওয়াও একটি দলের গণতান্ত্রিক অধিকার। এ নিয়ে ‘অতিকথন’ রাজনীতির জন্য সুখকর নয়।
১৯৯৬ সালে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদের শেষদিকে চারদলীয় জোটের ব্যানারে গাঁটছড়া বাঁধে বিএনপি-জামায়াত। পরবর্তী সময়ে গঠিত হয় ২০ দলীয় জোট। সেই জোট ভেঙে দেওয়ার আগে থেকেই বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে শুরু হয় নানা টানাপোড়েন। এ কারণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তাতে আনুষ্ঠানিকভাবে জামায়াতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ওই আন্দোলনের দুটি কর্মসূচি পালন করলেও বিএনপির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে পরবর্তী সময়ে সেসব থেকেও নিজেদের গুটিয়ে নেয় জামায়াত। পরে কারাগারে মাওলানা দেলাওয়ার হুসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে বিএনপির শোক প্রকাশ এবং তারেক রহমান ও তার স্ত্রী জোবাইদা রহমানের সাজা দেওয়ার প্রতিবাদে জামায়াতের বিবৃতির পর দুই দল আবার পরস্পরের কাছাকাছি আসতে শুরু করে। সর্বশেষ জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের সময় জাতীয় ঐক্যের আহ্বানে সাড়া দিলে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও নিবিড় হয় বিএনপির। কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা নিয়ে জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়। বিএনপি নির্বাচন নিয়ে রোডম্যাপ জানতে অতিদ্রুত সংলাপের দাবি জানালেও এ বিষয়ে ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে জামায়াত। এক সাক্ষাৎকারে দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান জানিয়েছেন, বিএনপি নির্বাচনের জন্য তোড়জোড় করছে, যেটাকে এ মুহূর্তে আমরা প্রাধান্য দিচ্ছি না। এ সময় জাতির ক্রাইসিস চলছে। বিভিন্ন জেলা বন্যার কবলে পড়েছে। এটিকে আমরা এ মুহূর্তের রাজনীতি হিসাবে নিয়েছি। আমরা মনে করি, এ বিষয়গুলো সমাধান না করে নির্বাচনের কথা তোলা যৌক্তিক নয়। তাই আমরা নির্বাচন নিয়ে কথা বলছি না।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ আগস্ট গুলশানে দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমি আগেই বলেছি, এটা সুপরিকল্পিত একটা চক্রান্ত। কারণ আমরা তো এক-এগারোর কথা ভুলে যাইনি। এক-এগারোতে যেটা হয়েছিল বিরাজনীতিকীকরণের প্রচেষ্টা। যাদের জনসমর্থন নেই, জনগণ মনে করে না যে এরা সরকার চালাতে পারবে, তারা এ ধরনের বিভিন্ন চিন্তাভাবনা করে, আমি কোনো দলের নাম বলছি না। সবচেয়ে বড় জিনিস হচ্ছে, আমাদের লড়াইটা গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য। সেটার জন্যই তো নির্বাচন। এটা তো আমাদের রাইট। আমরা তো নির্বাচনের জন্যই এতদিন লড়াই করেছি, সংগ্রাম করেছি।’
জামায়াতে ইসলামীকে ইঙ্গিত করে মির্জা ফখরুল বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে বাতিল করা হলো, এর জন্য ওই দলগুলো মিলেই তো আমরা আন্দোলন করেছি। অনেককে নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। এমনকি তাদের অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন ওই বিষয়কে বাদ দিয়ে আমি তো অন্য রাজনৈতিক চিন্তা এ মুহূর্তে করব না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক যুগান্তরকে বলেন, বিএনপি মহাসচিব নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়েছেন, এতে অসুবিধা কোথায়? এ নিয়ে বিরোধিতা না করে বা ওপেন না বলে জামায়াত বলতে পারত-আমরা একসঙ্গে বসে তা মিটমাট করব। তা না করে তাদের এভাবে বলা ঠিক হয়নি।
জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থানের সমালোচনা করে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু শুক্রবার রাজধানীতে এক সমাবেশে বলেন, কেউ কেউ বলছেন বন্যায় ভাসছি, আবার এখন নির্বাচনের দরকার কী? যারা যেমন, তারা তেমনই কথা বলবেন। কিছু মানুষ আছে, কিছু দল আছে আমাদের সঙ্গে থাকলেও ১৯টা সিট পায়, আমাদের থেকে বেরিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকলে তিনটা সিট পায়, তারা তো ভোটকে ভয় পাবেই। এটা অস্বাভাবিক কিছু না।
মঙ্গলবারও সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে আমাদের ওপর যারা জুলুম-নির্যাতন করেছে, আমরা তাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। আমরা সংশোধন ও ক্ষমার রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তবে কোনো ভিকটিম বা ভিকটিমের পরিবার যদি আইনের আশ্রয় নেয়, তাহলে আমরা তাদেরও সহযোগিতা করব। দল হিসাবে আমরা কোনো প্রতিশোধ নেব না।’
তার এ বক্তব্য নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বুধবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘গণহত্যাকারীদের কীসের ক্ষমা করতে বলেছেন তারা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার নির্দেশে যাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, তাদের হত্যাকারীদের ক্ষমা করলে নিহতদের আত্মার সঙ্গে বেইমানি করা হবে। ট্রাইব্যুনাল করে প্রতিটি হত্যার বিচার, প্রতিটি অপরাধের বিচার করতে হবে।
তবে জামায়াতের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানান, মাঠে অনেক রাজনৈতিক কথা হয়, তাতে বিএনপির সঙ্গে তাদের কোনো দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে তারা মনে করেন না। সব দলই সংস্কার চায়। তারা সংস্কারের জন্য কোনো সময় বেঁধে দিতে চান না। তাদের পারস্পরিক সম্পর্কে কোনো ঘাটতি হয়েছে বলে মনে করেন না।
তবে এখন তারা বিএনপির সঙ্গে জোটভুক্ত নয়। কিন্তু বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে। তারা ইসলামি দল ও সংগঠনের সঙ্গে এখন আলাপ-আলোচনা করছেন সবাই ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে কোনো জোট করবেন কি না, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। আর বিএনপির ব্যাপারেও তাদের একই অবস্থান। এখন কিছু বলা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে বিএনপির নেতারা জানান, তারা এখন এককভাবে চলতে চান। কারণ, এখন দেশের সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হচ্ছে বিএনপি। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জোট করবেন কি না, তখন সিদ্ধান্ত নেবেন। সামনে এখনো রাজনীতির অনেক হিসাবনিকাশ আছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. এএসএম আমানুল্লাহ মনে করেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় জামায়াত সেই ফাঁকা জায়গায় একটি শক্তি হিসাবে নিজেদের প্রকাশ করতে চাইছে। এ কারণেই তারা এখন বিএনপির বাইরে গিয়ে অবস্থান নিয়েছে। নির্বাচন দেরিতে হলে তাদের শক্তি আরও সংহত হতে পারে। তবে এতে ভোটের রাজনীতিতে বড় কোনো প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি না। কারণ, তাদের যে ভোট ব্যাংক, তা খুব বেশি বাড়বে না। কারণ, বাংলাদেশের ভোট মূলত বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত। নির্বাচন দেরিতে হলেও আওয়ামী লীগ অল্পকিছু আসন পেতে পারে। কিন্তু তারা অনেক ভোট পাবে বলে আমি মনে করি। আর জামায়াত যদি ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচন করে, তাহলে তাদের আসন কিছু বাড়বে। তিনি আরও বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নতুন দল গঠন করলে তার প্রভাব ভোটের রাজনীতিতে পড়বে না। কারণ, বাংলাদেশে ভোটের রাজনীতি আলাদা। তবে তাদেরকে মানুষ স্বাগত জানাবে।
Leave a Reply