ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি। ঝড়ের প্রথম আঘাতটা আসে এই বনের ওপরই। এতে কচিখালি, দুবলার চর, কটকা, হলদিবুনিয়া, নীল কমলসহ বিভিন্ন এলাকা ৭ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত পানির নিচে তলিয়ে যায়। আর বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছিল বন্য প্রাণীর। সেই ক্ষতির খবর আসতে শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত সুন্দরবনের পূর্ব ও পশ্চিম বন বিভাগের ৩০ থেকে ৩৫টি হরিণের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকালয়ের মতো সুন্দরবনের ক্ষতচিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। জোয়ারের পানিতে ডুবে যাওয়ায় বিভিন্ন স্থানে হরিণসহ বন্য প্রাণী মারা যাওয়ার খবর আসছে ধীরে ধীরে। এর মধ্যে মঙ্গলবার (২৮ মে) সকালে কটকার জামতলা পাড় এলাকার বিভিন্ন স্থানে ৩০টি মৃত হরিণ দেখতে পান বন কর্মীরা। ভাটায় পানি নেমে যাওয়ার পর এসব মৃত হরিণ দেখতে পাওয়া যায়। অনেক স্থানে নদীতেও মৃত হরিণ ভেসে থাকতে দেখা যায়। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় ১৭ টি জীবিত হরিণ। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন বিভাগের ২৫টি টহল ফাঁড়ি। লবণপানি ঢুকে নষ্ট হয়েছে কমপক্ষে ৮০টি মিষ্টিপানির পুকুর।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন জানান, সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থান অত্যন্ত দুর্গম। সব জায়গায় মোবাইল নেটওয়ার্কও নেই। এ কারণে সব খবর এখনও পাওয়া যায়নি। জীবিত উদ্ধার হরিণগুলোকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিভিন্ন স্থান থেকে আরও খবর নেয়ার চেষ্টা করছি।
এদিকে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মো. নুরুল করিম বলেন, দুবলার চরের জামতলা পাড়ে আমরা বেশ কিছু হরিণ মারা যাওয়ার খবর পেয়েছি। ২০ থেকে ৩০টি হরিণ সেখানে মারা গেছে বলে আমাদের জানানো হয়েছে। তবে এখনও নিশ্চিত নই। আরও বিভিন্ন স্থান থেকে খবর আসছে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীরা জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে অভ্যস্ত। সাধারণত জলোচ্ছ্বাস হলে বন্য প্রাণীরা উঁচু স্থান ও গাছে আশ্রয় নেয়। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে বনের ভেতর অধিক উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। ফলে বনের উঁচু স্থান তলিয়ে যাওয়ায় প্রাণীদের আশ্রয় নিতে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। অধিক জলোচ্ছ্বাসের ফলে নিরাপদ আশ্রয়ে না যেতে পেরে হরিণগুলোর মৃত্যু হয়েছে।
সুন্দরবন একাডেমির পরিচালক ফারুক আহমেদ বলেন, হরিণ অত্যন্ত নিরীহ প্রাণী। সুন্দরবনের পানিতে তলিয়ে গেলে, এরা শুকনো কোথাও উঠতে পারেনি। ফলে হরিণ মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। বন বিভাগের উচিৎ এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় হরিণের আশ্রয়স্থল বা উঁচু স্থান নির্মাণ করা, যাতে তারা সেখানে আশ্রয় নিতে পারে।
সুন্দরবন বিভাগের খুলনাঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো বলেন, মঙ্গলবার দুপুর তিনটা পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, সুন্দরবনের কটকা ও দুবলা এলাকাসহ বনের বিভিন্ন স্থান থেকে মোট ২৬ টি মৃত হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে। আরও হরিণের মৃত্যুর খবর আসছে। এছাড়া আহত অবস্থায় আরও ১৭টি হরিণ উদ্ধার করে বনরক্ষীরা। তবে হরিণের পাশাপাশি আরও বন্যপ্রাণী মারা যেতে পারে। সেসব মৃত প্রাণীর খোঁজে বনরক্ষীরা তৎপর রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বন বিভাগের টহল অফিসগুলোতে টিনের চালা, জানালা-দরজা, সোলার প্যানেল, ওয়ারলেস সিস্টেম ও অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। পূর্ব বন বিভাগের কটকা অভয়ারণ্যের অফিস ঘাটের জেটি ও পুকুর বঙ্গোপসাগর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। দুবলা, কটকা, কচিখালি, বগিসহ বিভিন্ন বন অফিসসহ ২৫টি টহল ফাঁড়ির রান্নাঘরসহ অবকাঠামোর টিনের চালা উড়িয়ে নিয়ে গেছে। সুন্দরবনের ৮০টি মিঠাপানির উৎস পুকুর ৮-১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে লোনা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বনকর্মীদের পাশাপাশি প্রাণীরাও সুপেয় পানির সংকটে পড়েছে।
Leave a Reply