বাড়তে পারে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার সংখ্যা!

নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টার সংখ্যা সম্প্রসারণের আলোচনা শুরু হয়েছে। বর্তমান উপদেষ্টাদের সঙ্গে আরো চার-পাঁচজন নতুন মুখ যুক্ত হতে পারেন। যেসব উপদেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়সহ একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁদের কাজের চাপ কমাতে নতুন উপদেষ্টা যুক্ত করা হবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাজে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা উপদেষ্টা পরিষদে আসতে পারেন—এমন আলোচনা রয়েছে।

সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

কবে নাগাদ উপদেষ্টা পরিষদ সম্প্রসারিত হবে, এর সুনির্দিষ্ট তারিখ কেউ বলতে পারছেন না। তবে এই বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগও প্রাথমিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে বলে জানা গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, উপদেষ্টা পরিষদ সম্প্রসারণের বিষয়ে চলতি মাসের শুরুতে একটা আলোচনা ছিল।

প্রধান উপদেষ্টা দেশে ফিরে কাজ শুরু করলে হয়তো এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আসতে পারে। এ ছাড়া নতুন উপদেষ্টা যুক্ত করার বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টার ওপর নির্ভর করছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে একটা সরকার যে কাজ করে, সেটা তো করছেই। এর সঙ্গে সংস্কারের জন্য আরো কিছু উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

ফলে কাজ তো অনেক। এই চাপটা যদি আরো কয়েকজন শেয়ার করেন, তাহলে তাঁরা সহজে আরো অনেক কাজ করতে পারবেন। তাই আমার মনে হয়, সরকারে আরো কয়েকজন উপদেষ্টা যুক্ত হলে ভালোই হবে। তবে এটা প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা পরিষদ ভালো বলতে পারবে। কারণ উনারা সব কাজ করছেন, আরো বেশি কিছু কাজ করার চেষ্টা করছেন।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। শুরুতে প্রধান উপদেষ্টাসহ এই সরকারের সদস্যসংখ্যা ছিল ১৭। এরপর এক সপ্তাহের ব্যবধানে গত ১৬ আগস্ট আরো চারজন উপদেষ্টা যুক্ত করা হয়। তবে আলোচনায় ছিল গত ১৬ আগস্ট পাঁচজন উপদেষ্টা যুক্ত হচ্ছেন। এর পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকারে আরো নতুন উপদেষ্টা যুক্ত হওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আছে।

মন্ত্রণালয়গুলোতে গতিশীলতা বাড়ানোর উদ্যোগ : ড. মুহাম্মদ ইউনূস একাধিকবার জানিয়েছেন, প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর নির্বাচন করাই অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য। তবে প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য সরকারকে অনেক কাজ করতে হবে। কিন্তু উপদেষ্টারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সচিবদের কাছ থেকে সেভাবে সহযোগিতা পাচ্ছেন না। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া সচিবরা নানা ধরনের অসহযোগিতা করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

তিনজন উপদেষ্টা তিনটি করে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। ১০ জন উপদেষ্টা দায়িত্ব পালন করছেন দুটি করে মন্ত্রণালয়ের। মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলো দ্রুত সচল ও গতিশীল করতে গত ১২ আগস্ট নিজের হাতে থাকা ২৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কর্মরত ২৮ জন সচিবকে নির্দেশ দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এর পরও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। পরে ১৬ আগস্ট আরো চারজন উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হয়।

৪ সেপ্টেম্বর সব মন্ত্রণালয়-বিভাগের সচিবদের নিয়ে বৈঠক করে কাজের গতি বাড়াতে আবার নির্দেশনা দেন প্রধান উপদেষ্টা। এর পরও উপদেষ্টাদের উদ্যোগ ছাড়া সহজে কোনো কাজ হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সচিবদের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির সভাও হয়নি। সচিবদের এই সভা না হওয়ায় রাষ্ট্রের জরুরি অনেক কাজ আটকে আছে। এতে সেবাবঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এখন মন্ত্রণালয়-বিভাগের কাজের গতি বাড়াতে সরকারে নতুন উপদেষ্টা যুক্ত করার বিষয়টি নিয়ে জোরালো আলোচনা হচ্ছে।

গত ১২ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে প্রশাসনে স্থবিরতা বিরাজ করছে স্বীকার করে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘প্রশাসনে স্থবিরতা তো আছে। এটা আমরা লক্ষ করছি। আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে অসহযোগিতা পাচ্ছি। আশা করি, দ্রুত সময়ের মধ্যে স্থবিরতা কেটে যাবে।’

আলোচনায় যেসব মন্ত্রণালয় : সরকারের মন্ত্রণালয়-বিভাগ রয়েছে ৫৮টি। এসব মন্ত্রণালয়-বিভাগে সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ছিলেন ৪৫ জন। একাদশ সংসদের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী ছিলেন ৪৭ জন। ড. ফখরুদ্দীন আহমদ সরকারের আমলে উপদেষ্টার সংখ্যা ছিল ১৬। এরপর নানা কাজের সংস্কারের পরিকল্পনা নিয়ে গঠন করা সরকারে উপদেষ্টা আছেন ২১ জন। স্বরাষ্ট্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন লে. জে. (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

বর্তমান সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনেক কাজ। একই সঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়েও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। পরিকল্পনা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করছেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। এর মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আওয়ামী লীগের অনেক রাজনৈতিক প্রকল্পসহ নানামুখী চ্যালেঞ্জ আছে। এদিকে তিনটি করে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন অর্থ ও বাণিজ্য এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে সালেহউদ্দিন আহমেদ, আসিফ নজরুল আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ে মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। সহজে কাজ করার জন্য এসব মন্ত্রণালয়ে নতুন মুখ যুক্ত হতে পারে। আবার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোতেও পরিবর্তন আসতে পারে।

এ ছাড়া স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ে হাসান আরিফ, মো. তৌহিদ হোসেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের, আদিলুর রহমান খান শিল্প মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে আলী ইমাম মজুমদার, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের, নাহিদ ইসলাম ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের, আসিফ মাহমুদ যুব ও ক্রীড়া এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের, ফারুক-ই-আজম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন।

এ ছাড়া বস্ত্র ও পাট এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, নূর জাহান বেগম স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের, বিধান রঞ্জন রায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের, ফরিদা আখতার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের, মহিলা ও শিশু বিষয়ক এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে শারমিন এস মুরশিদ, আ ফ ম খালিদ হাসান ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ও সুপ্রদীপ চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অধীনে আছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, খাদ্য মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *