ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিনই দেশ ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে অবস্থান নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকে গণহত্যা, হত্যাচেষ্টা, বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি ও অন্যান্য অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় ও তৃণমূলের নেতাদের নামে একের পর এক মামলা হচ্ছে। মামলা হচ্ছে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্য-স্বজনদের বিরুদ্ধেও। তবে ইতিমধ্যে বেশ কজন সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও তৃণমূলের অনেক নেতাকে গ্রেফতার করা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন শেখ হাসিনার স্বজনরা।
শেখ হাসিনার স্বজনরা গত সাড়ে ১৫ বছরে সরকারের মন্ত্রী, এমপি, মেয়র হওয়া ছাড়াও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্যসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে মন্ত্রী ও সমপদমর্যাদায় ছিলেন চারজন। এমপি হয়েছেন অন্তত ১০ জন। দুই সিটিতে মেয়র হয়েছেন তিনজন। সহযোগী সংগঠনের প্রধান হয়েছেন একজন। বৈধ ও অবৈধভাবে সরকারের সব রকমের সুযোগ নিয়েছেন তারা। অথচ এখনও তারা প্রশাসনের নাগালের বাইরে রয়েছেন। গুরুতর অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও শেখ হাসিনার স্বজনদের আইনের আওতায় না আনায় প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন মহলে। বর্তমান সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র বলছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ১৫ আগস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম মামলা হয় ঢাকার আদালতে। এরপর তার বিরুদ্ধে অন্তত ২২২টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৮৮টি মামলায় হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
এসব মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও তার সরকারের সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও তৃণমূলের নেতা, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শকসহ (আইজিপি) বিভিন্ন পেশার লোকজনকে আসামি করা হয়। ইতিমধ্যে কোনো কোনো মামলায় শেখ হাসিনার সরকারের কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও দলের কিছু নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শেখ হাসিনার স্বজনদেরও খুব দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। যদিও শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট দেশ ত্যাগ করেছেন। তার স্বজনরাও কেউ কেউ গোপনে দেশ ছাড়েন। আবার অনেকে আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।
এদিকে রাজনৈতিকসহ সব মহলে প্রশ্ন উঠেছে, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করেছেন, এটি সবার জানা। ওই দিনই তড়িঘড়ি পদত্যাগ করে সামরিক বিমানে দেশ ত্যাগ করেন তিনি ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা। ওই দিন তারা দুজনই গণভবনে ছিলেন। তারা এখন ভারতেই অবস্থান করছেন। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে দিল্লিতে কর্মরত। সরকারের পতনের সময় তিনি দিল্লিতেই ছিলেন। শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ মন্ত্রী, তিনি লন্ডনে বসবাস করেন। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের অন্য সদস্য ও স্বজনরা কোথায়?
একাধিক সূত্রে জানা যায়, শেখ রেহানার ছেলে রেদওয়ান সিদ্দিক সরকার পতনের আগেই দেশ ছেড়েছেন। বঙ্গবন্ধু পরিবারের আরেক সদস্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস সরকার পতনের দুদিন আগে সিঙ্গাপুর চলে যান। শেখ ফজলে নূর তাপসের বড় ভাই শেখ ফজলে শামস পরশ আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান। তিনি দেশে আছেন নাকি বিদেশে, এ নিয়ে সংগঠনের কারও কাছে তথ্য নেই। তবে যুবলীগের তৃণমূল পর্যায়ের একাধিক নেতা জানিয়েছেন ফজলে শামস পরশও দেশে নেই। আন্দোলন চলাকালে কোনো এক সময় তিনি বিদেশে চলে গেছেন। তবে পরশের স্ত্রী অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা যূথি কি দেশে আছেন না তার সঙ্গে বিদেশে গেছেন, সে সম্পর্কিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের অবস্থান নিয়ে রয়েছে ধূম্রজাল।
শেখ হাসিনার চাচা শেখ কবির হোসেন দেশেই আছেন বলে তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে। শেখ ফজলুল করিমের ছোট ভাই শেখ ফজলুর রহমান মারুফ আগে থেকেই সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য হাসানাত আবদুল্লাহ বরিশাল-১ (গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া) থেকে নির্বাচিত সাবেক এমপি। তার ছোট ছেলে সেরনিয়াবাত আশিক আবদুল্লাহকে নিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন। হাসানাত ভারতে আছেন তার মেয়ে আঞ্জুমানারা কান্তা আবদুল্লাহর কাছে। কান্তা একজন ভারতীয় নাগরিককে বিয়ে করে সেখানেই বসবাস করেন। আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর মেজো ছেলে মঈন আবদুল্লাহ ও তার আরেক ছেলে বরিশাল সিটির সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ এবং আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছোট ভাই সিটির বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত আবুল খায়ের আবদুল্লাহ দেশেই আত্মগোপনে রয়েছেন বলে একাধিক সূত্র দাবি করেছে। সাদিক আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে মানুষের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তিনি মানুষের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন। দুর্নীতিগ্রস্ত, মাদকাসক্ত সাদিক আবদুল্লাহ টর্চার সেল তৈরি করেছিলেন।
বাগেরহাট-১ আসনের সাবেক এমপি শেখ হেলাল সরকার পতনের আগেই দেশ ছেড়ে গেছেন। তবে তার ছেলে বাগেরহাট-২ আসনের সাবেক এমপি শেখ সারহান নাসের তন্ময় দেশ ছাড়তে পারেননি। তিনি দেশেই আত্মগোপনে আছেন। শেখ হেলালের ভাই খুলনা-২ আসনের সাবেক এমপি শেখ সালাউদ্দীন জুয়েলকে সরকার পতনের পর টুঙ্গিপাড়ায় দেখা গেছে। তবে সর্বশেষ তার অবস্থান নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা, তিনি কি দেশেই আছেন না বিদেশে গেছেন। শেখ হাসিনার আরেক ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে ও সাবেক চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী (লিটন চৌধুরী)।
গত ৫ আগস্টের পর তারও আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনি কোথায় আছেন? তবে তার ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, তিনি আত্মগোপনে আছেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মীয়ের মধ্যে ফরিদপুর-৪ আসন থেকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে বিজয়ী হওয়া সাবেক এমপি মুজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন চৌধুরীও রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তিনি কি দেশেই আছেন না বিদেশে গেছেন কেউ বলতে পারছেন। তবে একাধিক সূত্রে বলছে, তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও জাতীয় পার্টির মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম আছেন ঢাকায়। শেখ সেলিমের স্ত্রী ফাতেমা সেলিম, যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম, শেখ ফজলে নাইম, শেখ আমিনা সুলতানা সানিয়া কোথায় আছেন কেউ জানেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক ড. সাবের আহমেদ চৌধুরী সময়ের আলোকে বলেন, বর্তমান সরকার প্রতিনিয়তই আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো না কোনো সুবিধাভোগী বা সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের গ্রেফতার করছে। সেখানে শেখ হাসিনার স্বজনদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না সেটি বলা ঠিক হবে না। আসলে তারা কি দেশে আত্মগোপনে আছেন নাকি গোপনে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন সেটি স্পষ্ট নয়। আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি, সেনাবাহিনী থেকে বলা হয়েছে, ক্যান্টনমেন্টে ছয় শতাধিক লোক আছে। তারা কারা, সেটি কিন্তু স্পষ্ট করেনি সেনাবাহিনী। সেখানেও তো শেখ হাসিনার স্বজনরা থাকতে পারেন। এ ছাড়া কেউ যদি আত্মগোপনে থাকেন, তাদের গ্রেফতার করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। হয়তো তাদের খোঁজ পেতে প্রশাসনের সময় প্রয়োজন হচ্ছে। তবে তাদের গ্রেফতার করবে না বা করতে পারে না এটি বলা ঠিক হবে না। শেখ হাসিনার স্বজনরা যদি দুর্নীতি, অনিয়ম ও সরকারে থেকে কোনো অপকর্ম করে থাকেন তাহলে তারা রেহাই পাবেন না। তবে কেন তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না, সেটা স্পেসিফিকভাবে বলা কঠিন।
এ প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলামের মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ সেনসেটিভ ইস্যুতে আমি কথা বলতে চাচ্ছি না। কারণ এটি সরকারের বিষয়। সরকার কী করবে না করবে সেটি তারা ভালো জানে।
শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের অনেকের বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না বলে প্রশ্ন উঠেছে-এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর সময়ের আলোকে বলেন, অপরাধীদের, মামলার আসামিদের গ্রেফতারের জন্য বাংলাদেশ পুলিশ তৎপর রয়েছে। প্রতিনিয়তই বিভিন্ন মামলার আসামিকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। মামলার আসামিদের গ্রেফতার করার জন্য পুলিশের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে এবং থাকবে।
বিষয়টি সম্পর্কে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল মুনীম ফেরদৌস সময়ের আলোকে বলেন, আমরা আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি, নজরদারি করছি। যদি কারও কাছে তাদের সম্পর্কে তথ্য থাকে আমাদের দিতে পারেন। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে আমরা তাদের অবশ্যই গ্রেফতার করব।
Leave a Reply