আসিফ নজরুলের অপসারণ দাবি!

জুলাই-আগস্টের রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানকে সফল করতে ভারত ও হাসিনাপন্থী উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থেকে বাদ দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
দেড় দশকের মাফিয়াতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ ও গণহত্যার অপরাধে শেখ হাসিনার বিচারকে প্রলম্বিত করার অ্যাজেন্ডা নিয়ে মাঠে নেমেছেন তিনি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারক নিয়োগ দেননি। এর আগে তিনি মাঠে ছেড়েছেন ‘১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ আইন সংশোধন ইস্যু। দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারপতিদেরও বহাল রেখেছেন। আটকে রেখেছেন হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক নিয়োগ উদ্যোগ। নানাবিধ সংস্কারের কথা বলে তৈরি করেছেন সংবিধান সংস্কার কমিশন। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। পক্ষান্তরে নিজেরই যেখানে সাংবিধানিক এবং আইনগত ভিত্তি নেই, সেখানে সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান, বিএনপি চেয়ারপাসেন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, তার গৃহবধূ স্ত্রী ডা: জোবাইদা রহমানের সাজা বাতিল এবং মামলা প্রত্যাহারে আইন প্রতিপালনের বুলি কপচাচ্ছেন। এসব করে যেকোনো প্রকারে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত শেখ হাসিনা এবং তার দোসরদের ‘আন-কনভিক্ট’ রাখা, যাতে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। পক্ষান্তরে তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে অমার্যাদাপূর্ণ ও গ্লানিকর করে রাখছেন। তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে বিলম্বিত করার অর্থ হচ্ছে, বিএনপিকে তারেক রহমানের সশরীর সান্নিধ্য লাভ থেকে বঞ্চিত রাখা, দলীয় কোন্দল জিইয়ে রাখা এবং আগামি নির্বাচন পর্যন্ত দলটিকে ক্ষমতার বাইরে রাখা। যা ভারত এবং শেখ হাসিনার যৌথ এবং চূড়ান্ত প্রত্যাশা। তাদের প্রত্যাশা পূরণে সূক্ষ্ম কৌশলে ভারত ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকারে ‘আইন উপদেষ্টা’ হিসেবে ড. আসিফ নজরুলকে ঢুকিয়ে দেয়।

গত সোমবার প্রকাশিত ‘কোন্ দিকে খেলছেন আসিফ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের পর নাগরিক সমাজে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের ভূমিকা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বিষয়টি পরিণত হয় ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’তে। শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, বিচারক-নির্বিশেষ করেছেন বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ। সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক শেয়ার হয়েছে। খোলামেলা মন্তব্য করে পাঠক সমাজও।

মো. ইউসুফ লিখেছেন, ‘আসিফ নজরুলকে বরখাস্ত করুন। জাতির আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটান।’ রাফি লিখেছেন, ‘রক্তাক্ত বিপ্লবকে কৌশলে ব্যর্থ করার মাস্টারমাইন্ড তিনি। ক্লাসে পাঠদান আর আইনমন্ত্রণালয় পরিচালনা এক কাজ নয়।’ আরেক পাঠক ড. আসিফ নজরুলকে ‘৩৬০ ডিগ্রি পার্সন’ বলে উল্লেখ করেন। শাহরিয়ার হোসাইন ইনকিলাবের প্রতিবেদন পোস্ট করে বলেছেন, ‘আসিফ নজরুল কোন্ পন্থী? হাসিনার এত সমালোচক কিন্তু জেলে যেতে হলো না। এখন কার হয়ে কাজ করছেন ? বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ধরলে আর ছাড়বে না। সাবধান আসিফ সাহেব!’

সাংবাদিক মাসুদ মজুমদার এক পোস্টে বলেছেন, ‘ভারতীয় এজেন্ট আসিফ নজরুলের দুর্নীতির অনেক প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। ইতোমধ্যে ইনকিলাব যত সুন্দরভাবে ভারতীয় ‘র’ এর এজেন্ট আসিফ নজরুলের বিষয়ে যে নিউজ করেছে তার জন্য ইনকিলাবকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ভবিষ্যতে সম্মানিত করা হবে ইনশাআল্লাহ।’

ইনকিলাব প্রতিবেদন সম্পর্কে কর্নেল (অব.) মো. শহিদ উদ্দীন খানের কমেন্টের রিপ্লাইয়ে সাংবাদিক মাসুদ মজুমদার আরো বলেন, দৈনিক ইনকিলাব এই গণঅভ্যুত্থান হাইজ্যাককারী ‘র’ এর এজেন্টের বিস্তারিত দুর্নীতির রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সে সম্পূর্ণভাবে ভারতের প্রেসক্রিপশনে জঙ্গি লীগকে পুনর্বাসনের দায়িত্বে নিয়োজিত। আইন ও বিচার বিভাগের কোনো অগ্রগতি নেই। অপর দিকে বিতর্কিত সব লোকজনকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিয়েছে, যারা আওয়ামী দোসর। …বাট দুর্ভাগ্যের বিষয় জাতি এখনো নিশ্চুপ!!

এমন অজস্র মন্তব্যে সয়লাব সোশ্যাল মিডিয়া। এদিকে অফিস-আদালত, বিভিন্ন কর্মস্থলে প্রাসঙ্গিকতা পায় আসিফ নজরুল প্রসঙ্গ। আড্ডায় সিনিয়র এক আইনজীবী (একজন বিচারকও উপস্থিত ছিলেন) মন্তব্য করেন, বিপ্লবোত্তর সরকারের আইন উপদেষ্টার অগ্রাধিকারভিত্তিক অ্যাজেন্ডা হওয়া উচিত ছিল গণহত্যার বিচার। সেই বিচারকে প্রহসনে পরিণত করতেই আসিফ নজরুল রাত-দিন কাজ করে যাচ্ছেন। প্রথমত, জুলাই-আগস্ট গণহত্যার প্রধান যে আসামি তাকে নিরাপদে পালিয়ে যেতে দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিচার যাতে প্রলম্বিত হয় এ লক্ষ্যে এটা-ওটা করে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। ১৯৭৩ সালের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টের যে সংশোধনের কথা বলা হচ্ছে, এটির আদৌ প্রয়োজন নেই। শেখ হাসিনা যে সংশোধন করে গেছেন সেটিই যথেষ্ট। যদি সংশোধন প্রয়োজনও হয় সেটি হতে পারে গণহত্যার বিচারের পর। বিচারের আগে আইনের সংশোধন বিচারকে পিছিয়ে দেবে। ততদিনে জাতীয় নির্বাচন সামনে চলে আসবে। তাতে নির্বিঘ্নে অংশ নিতে পারবে শেখ হাসিনা এবং তার দল। সেই সুযোগ করে দিতেই চলছে নানা টালবাহানা। শেখ হাসিনা নিয়োজিত বিচারকদের বেছে বেছে ভালো জায়গাগুলোতে পোস্টিং দেয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে ১৫ বছর ধরে নিগৃহীত বিচারকদের দেয়া হচ্ছে ডাম্পিং পোস্টিং। শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত বিচারক গোলাম রাব্বানীর চাকরির মেয়াদ দুই বছর করার সুপারিশ করেছেন আসিফ নজরুল। এটিও তার গোপন অ্যাজেন্ডার অংশ। হাইকোর্ট বিভাগের দলবাজ-দলকানা বিচারপতিদের স্বপদে বহাল রেখেছেন এখনো। নতুন বিচারপতি নিয়োগের কোনো খবর নেই। তাই খবর নেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনেরও। জাতীয় আইন কমিশনের চেয়ারম্যান করেছেন হাসিনার ফ্যাসিবাদের একনিষ্ঠ সমর্থক বিচারপতি জিনাত আরাকে। কমিশনের সদস্য নিয়োগ দিয়েছেন ফ্যাসিবাদের গডফাদার কথিত বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের ভাতিজি ড. নাইমা হককে। যদিও ‘আইন কমিশন’ কোনো বিচেনায়ই বিপ্লবোত্তর সরকারের আশু করণীয় হিসেবে ‘অগ্রাধিকার’ পেতে পারে না। মূলত আসিফ নজরুলের ব্যক্তিগত পছন্দের মানুষগুলোকে বিভিন্ন জায়গা দ্রুত পুনর্বাসন করে গোপন অ্যাজেন্ডাই বাস্তবায়ন করতে চান। আগামীর সরকার গঠনে সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি যাতে প্রত্যাশানুগ ফলাফল করতে না পারেÑ চলছে সেই অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নও। নিজে বেআইনি হলেও আইনি বাধ্যবাধকতা প্রতিপালনের মোড়কে বাধ্য করতে চাইছেন জাতির ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি তারেক রহমানকে। তার বিরুদ্ধে দেয়া ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের করা সব প্রকার মামলা (দণ্ডাদেশ হওয়া এবং বিচারাধীন) এক আদেশেই যেখানে বাতিল করা প্রয়োজন ছিল, আসিফ নজরুল সেখানে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বের করছেন ‘আইনি অন্তরায়’। অথচ বিপ্লবোত্তর কোনো সরকারই পূর্বতন সরকারের আইন প্রতিপালনে বাধ্য নন। শেখ হাসিনা উৎখাত হওয়ার পর তারই রেখে যাওয়া সংবিধানের আওতায় শপথ নিয়ে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের মূলে প্রথম কুঠারাঘাতটি করেছেন। শেখ হাসিনার সংবিধানকেই সরাসরি স্বীকৃতি দিয়েছেন। যদিও এ সংবিধানে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’র কোনো বিধানই নেই।

জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সময় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা সারা দেশে স্থাপিত শেখ মুজিবের মূর্তি গুড়িয়ে দিয়েছেন। কথিত ‘জাতির পিতা’র ছবি নর্দমায় ছুড়ে ফেলেছেন। অথচ আসিফ নজরুল সরকারের উপদেষ্টা হয়েও শেখ মুজিবের প্রতিকৃতিকে মাথার ওপর ঠাঁই দিয়েছেন। যাতে তার আওয়ামী-প্রীতির নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তদুপরি হাসিনার সংবিধানে উল্লিখিত ‘জাতির পিতার প্রতিকৃতি’ (৪ক) প্রসঙ্গে সরকারের অবস্থানও স্পষ্ট করেননি ড. আসিফ। ফলে সারা দেশে মুজিব-মূর্তিসমূহ গুড়িয়ে দেয়া হলেও বিভিন্ন সরকারি দফতরের কর্তাব্যক্তিদের মাথার ওপর এখনো শোভা পাচ্ছে মুজিবের ছবি। ‘ফ্যাসিবাদের মূর্তপ্রতীক’ হিসেবে আসিফ নজরুলদের মধ্যে ফ্যাসিবাদকে প্রতিবিম্বিত করছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *