দীর্ঘদিন আবাসিক বাড়িতে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। কয়েকবার গ্যাস সংযোগ দেওয়ার কথা বলেলেও আওয়ামী লীগ সরকার সেটা দিতে পারেনি। এবার আবাসিক বাড়িতে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। একইসঙ্গে চুলা বা বার্নার বর্ধিতকরণের বিষয়টি অনুমোদন পেতে পারে। জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
তিতাস গ্যাস কোম্পানির মাধ্যমে পেট্রোবাংলা হয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার কাছে এমন প্রস্তাব এসেছে। বিষয়টি উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির একাধিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির কর্তকর্তা-কর্মচারীরা বলেছেন, কার্যত আবাসিক গ্যাস সংযোগ বৈধ উপায়ে বন্ধ থাকলেও অধিকাংশ গ্রাহক অবৈধ উপায়ে নিয়েছে। এ ছাড়া প্রায় প্রতিটি পুরনো গ্রাহকেরই বার্নার সংখ্যা বেড়েছে। এতে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
জানা গেছে, সম্প্রতি তিতাস গ্যাস কার্যালয়ে সবশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতিতে সমন্বয়সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, দিনের পর দিন আবাসিক খাতে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও অভিযান চালিয়ে সবাই প্রায় ক্লান্ত। কারণ, আবাসিক খাতে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে অবৈধ ব্যবহার হচ্ছে। সব বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিহ্নিত করা তিতাসের জন্য কঠিন কাজ। তবে গ্রাহকরা অবৈধভাবে ব্যবহার করতে চায় না। বৈধ সংযোগ বন্ধ থাকায় অবৈধ ব্যবহার বাড়ছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, মোট গ্যাসের শতকরা ১২ শতাংশ ব্যবহার করা হয় আবাসিক খাতে। বাকিটা শিল্প ও অন্যান্য খাতে। অথচ প্রায় সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে আবাসিক খাতে অবৈধ ব্যবহার বন্ধের অভিযানে। অন্যদিকে শিল্পে হাজার হাজার অবৈধ সংযোগ থাকলেও সেদিকে নজর কম দেওয়া হচ্ছে।
মাঠ কর্মকর্তারা বলছেন, আবাসিক খাতে নতুন সংযোগ বা বার্নার বর্ধিতকরণের অনুমোদন দিলে বিদ্যমান ব্যবহারের মধ্যেই শতকোটি টাকা রাজস্ব বাড়বে। নতুন গ্যাস বরাদ্দের দরকার হবে না। গ্রাহকরা কেবল কাগজ কলমে বৈধতা পাবে।
কর্মকর্তারা আরও বলেন, কোনো কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানে একদিনে যে পরিমাণ অবৈধ গ্যাসের ব্যবহার হয়, তাতে দুই-চার লাখ আবাসিক গ্রাহকের কয়েক মাসের ব্যবহারের সমান। ফলে আমাদের উচিত শিল্পেও অভিযান জোরদার করা। সরাসরি আবাসিক গ্যাস সংযোগ না দিলেও অন্তত বার্নার বর্ধিতকরণের বিষয়টি অনুমোদন পাওয়া উচিত।
পেট্রোবাংলার এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, অবৈধ গ্যাস সংযোগ নেওয়া এখন অত্যন্ত সহজ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ প্রদানে একাধিক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এসব সিন্ডিকেটকে প্রভাবশালী স্থানীয় মহল সমর্থন দিয়ে আসছে। ফলে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো চাইলেও অবৈধ গ্যাস সংযোগ বন্ধ করতে পারছে না।
তিনি আরও বলেন, যাদের আগে একটা বা দুটো গ্যাসের বার্নার অনুমোদন ছিল সময়ের সঙ্গে তারা বাড়িয়ে নিয়েছে। কিন্তু বিতরণ কোম্পানিগুলো যথেষ্ট লোকবলের অভাবে সব বাড়ি বাড়ি গিয়ে এগুলো চেক করতে পারছে না। অন্যদিকে যাদের চেক করে দেখার দায়িত্ব তারাও অনেক সময় অবৈধ সুযোগ নিয়ে চলে আসছে। ফলে অবৈধ গ্যাস ব্যবহার বন্ধ করা বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু চুলা বর্ধিতই না, অনুমোদনের বাইরে অনেক এলাকায় নতুন বাড়িঘরে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
তিতাস বর্তমানে তার বিতরণ এলাকায় সাড়ে ২৮ লাখের বেশি গ্রাহকের কাছে আবাসিক গ্যাস সরবাহ করছে। তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার ধারণা, বৈধভাবে সাড়ে ২৮ লাখ আবাসিক গ্রাহক থাকলেও অবৈধ প্রায় সমান রয়েছে। একদিকে তিতাস কর্তৃপক্ষ অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করছে অন্যদিকে আবার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অবৈধ সংযোগ নিয়ে নিচ্ছে।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে জ্বালানি বিভাগ বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয় আবাসিক খাতে আর কোনো গ্যাস সংযোগ দেওয়া হবে না। ডিমান্ড নোট ইস্যু করা গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে। দেশের সবেচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্রাহকদের ডিমান্ড নোটের টাকা ফেরত দিতে একটি কমিটি করেছিল। কমিটির দায়িত্ব ছিল সঠিক গ্রাহক চিহ্নিত করে তাদের টাকা ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া খুঁজে বের করা। তবে ২০২৪ সালেও গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারেনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জ্বালানি বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, অবৈধ আবাসিক গ্যাস সংযোগ ব্যাপক আকারে বেড়েছে। মাঝেমধ্যে উচ্ছেদ অভিযান চালালেও সেটা সফল হচ্ছে না। এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা প্রতিবেদন দিয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, গ্যাস সংযোগ চালু রাখলেই অবৈধ সংযোগ কমে আসবে। জ্বালানি বিভাগও সেই প্রস্তাব অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে মত দিয়েছে। তবে গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর কারণে এতদিন অনুমোদন দেওয়া যায়নি। এখন একটি প্রস্তাবনা জ্বালানি উপদেষ্টা বরাবর পাঠানো হয়েছে। সেটি অনুমোদন হলে নতুন সংযোগ মিলতে পারে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়। এরপর ২০১৩ সালের শেষের দিকে আবারও সংযোগ চালু করা হয়। কিন্তু ২০১৪ সালের পর আবার জ্বালানি বিভাগ থেকে বিতরণ কোম্পানিকে আবাসিকের নতুন আবেদন নিতে নিষেধ করা হয়। পরে ২০১৯ সালে লিখিতভাবে আবাসিক সংযোগ স্থগিত রাখার আদেশ জারি করা হয়।
Leave a Reply