বাংলাদেশে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাস পার না হতেই নানা বিষয়ে আলোচনা ও সমালোচনা সামনে এসেছে। এগুলো শুধু আলোচনা কিংবা সমালোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং তা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য নানামুখী চাপ তৈরি করছে বলে অনেকে মনে করেন।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলো অন্তর্বর্তী সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার থেকে লাভ করেছে। অন্যদিকে কিছু ইস্যু অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য নতুন করে সামনে এসেছে।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজের অধ্যাপক মুশতাক খান মনে করেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার দৃঢ় পদক্ষেপ প্রয়োজন।
‘মানুষ কিছু অ্যাকশন দেখতে চায়, তাতে সবকিছুর সমাধান হবে না। এখানে যে কোনো সেক্টরে হাত দিলেই আপনি দেখবেন অনেক অনিয়ম হয়েছে। অনিয়মের কোনো শেষ নাই,’।
‘আপনি এমন কিছু করবেন না যা পরে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বড় বড় কয়েকটা কাজ করতে হবে। যাতে মানুষ বুঝতে পারে যে একটা পরিবর্তন আসছে।’
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে ফেলবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে ডিমের দাম ডজন প্রতি ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যাওয়া।
গত পাঁচই অক্টোবর বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন এক বিবৃতিতে বলেছে, দেশের বাজারে ডিম এবং মুরগির বাচ্চার দাম বাড়িয়ে গত ২০ দিনে ২৮০ কোটি টাকা ভোক্তাদের পকেট থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।
শুধু সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সুদের হার বাড়িয়ে তারা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। কিন্তু এ বিষয়টি যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
‘যেসব বড় সিন্ডিকেটের মালিকরা হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে বসে আছে এবং তারা সে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, আপনাকে সে টাকায় হাত দিতে হবে।’
গার্মেন্টস খাত
নানা দাবিকে কেন্দ্র করে গার্মেন্টস খাতের শ্রমিকদের আন্দোলন এখনো বিক্ষিপ্তভাবে চলছে। এই আন্দোলনের ব্যাপকতা প্রথম দিকে আশুলিয়া এবং গাজীপুরে ছিল। আশুলিয়া এলাকায় পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হলেও গাজীপুরে এখনো বিক্ষিপ্তভাবে আন্দোলন চলছে।
প্রায়শই কোন না কোন ফ্যাক্টরিতে অস্থিরতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে আশংকা করছেন, এ পরিস্থিতি আবারো যে কোন সময় বড় আন্দোলনের দিকে রূপ নিতে পারে।
সরকারের তরফ থেকে ক্রমাগত পরিস্থিতি উন্নতির দিকে বলা হলেও এটি পুরোপুরি স্বাভাবিক নয় বলেই মনে করেন অনেকেই।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্ততকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি রুবানা হক বর্তমান পরিস্থিতিকে পোশাক খাতের জন্য একটা ‘বড় ধাক্কা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
‘বারো থেকে পনেরো দিন প্রচুর ফ্যাক্টরি বন্ধ থেকেছে। একেবারে বন্ধ। কেউ কেউ আবার ধরেন দুপুর পর্যন্ত চালাতে পেরেছে এরপর পারেননি। এগুলো তো পুরাটাই লস। এর চাইতে বড় লস যেটা হচ্ছে- সেটা হলো আমাদের যারা ক্রেতা তারা তো সরে যাচ্ছেন’।
বাস্তবতাটা হলো অন্তত শতকরা ২৫-৩০ ভাগ অর্ডার ডিসেম্বরের মধ্যে সরে যাবে।”
তিনি বলেন, পোশাক খাতে অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে ক্রেতারা কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ভারতে, পাকিস্তান এমন কী মিয়ানমারে চলে যাচ্ছে।
সড়কে বিশৃঙ্খলা
গত দুই মাসে ঢাকা এবং তার আশপাশের এলাকায় যানজটের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠছে প্রতিদিন। কয়েক কিলোমিটার দূরত্বে যেতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগছে।
যানজটে নাকাল মানুষ প্রতিদিনই ফেসবুকে তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরছেন। গত পাঁচই অগাস্টের পর অনেকের মনে প্রত্যাশা ছিল যে সড়কে যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতা কাটিয়ে হয়তো শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।
কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি উল্টো হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। কেন এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেটিও নিয়েও রয়েছে নানা বিশ্লেষণ।
কেউ বলছেন, ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে না। কেউ বলছেন, পুলিশের শিথিলতার কারণে ট্রাফিক আইন মেনে চলা এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখার কোনো তোয়াক্কা করা হচ্ছে না।
গত ১৬ই সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসনে দ্রুত ও কার্যকর সমাধান খুঁজতে পুলিশ ও দেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি সে বৈঠকে বলেছিলেন, ‘আমাদের যানজট নিরসন হবে। অবিলম্বে এর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।’
প্রশাসনে অস্থিরতা
জনপ্রশাসনে অস্থিরতা এবং এবং পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সম্প্রতি জেলা প্রশাসক নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় আকারে ঘুষ লেনদেনের খবর প্রকাশিত হয়ে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে।
সেখানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এবং একজন যুগ্ম সচিবের মধ্যে কথিত হোয়াটস্অ্যাপ বার্তা চালাচালি নিয়ে নানা অভিযোগ ওঠে।
জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে অন্তর্বর্তী সরকারের তিন উপদেষ্টার সমন্বয়ে ‘উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি’ গঠন করেছে সরকার।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, কেন্দ্র থেকে মাঠ প্রশাসনে নীরব অস্থিরতা বিরাজ করছে। এতে গোটা প্রশাসনের স্বাভাবিক কার্যক্রম চরমভাবে ব্যহত হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিতর্ক
রাজনৈতিক বিতর্ক যেন অন্তর্বর্তী সরকারের পিছু ছাড়ছে না। সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক দৃশ্যমান হয়েছে।
নিউ ইয়র্ক সফরকালে ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিটিয়েটিভ-এর অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস তার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমকে গণঅভ্যুত্থানের পেছনে মূল কারিগর হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন, যেটিকে অনেক ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
এ বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। ফেসবুকে অনেকে মতামত প্রকাশ করেন যে এই আন্দোলন জনগণের স্বতঃ:স্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে সংগঠিত হয়েছে, যার সামনের সারিতে ছিল ছাত্ররা। রাজনৈতিক দলগুলোও দাবি করছে, এই আন্দোলনে তাদের ভূমিকা কম নয়।
আরেকটি বিতর্কে বিষয়ে হচ্ছে ‘রিসেট বাটন’। ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিটিয়েটিভ-এর অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, তারা (তরুণরা) বলেছে ‘রিসেট বাটন’ চেপেছে এবং পুরাতন বিদায় নিয়েছে।
একই কথা তিনি বলেছেন, ভয়েস অব আমেরিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে। এ বিষয়টি নিয়ে তীব্র রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়।
এই রিসেট বাটন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক এতদূর গড়িয়েছে যে অনেকেই তাদের ফেসবুক পোস্টে হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে লিখছেন ‘স্টেপ ডাউন ইউনূস’। অর্থাৎ, ‘ইউনূসকে হটাও’। অনেকেই বলছেন, চাইলেই অতীত মুছে দেওয়া যায় না।
বিষয়টি নিয়ে ব্যাখ্যা দিতে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে। ১০ই অক্টোবর তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক বিবৃতি দিয়েছেন।
সে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ‘রিসেট বাটন’ চাপার কথাটি উল্লেখ করে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি, যা বাংলাদেশের সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে, অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে এবং কোটি মানুষের ভোটাধিকার ও নাগরিক অধিকার হরণ করেছে, সেটি থেকে বের হয়ে এসে নতুনভাবে শুরু করার কথা বুঝিয়েছেন।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, “তিনি কখনোই বাংলাদেশের গর্বিত ইতিহাস মুছে ফেলার কথা বলেননি। এখানে উল্লেখ্য যে, কেউ যখন কোনও ডিভাইসে রিসেট বোতাম চাপেন, তখন তিনি নতুন করে ডিভাইসটি চালু করতে সফটওয়্যার সেট করেন। এতে হার্ডওয়্যার পরিবর্তন হয় না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের হার্ডওয়্যার।”
‘দ্রুত অ্যাকশন প্রয়োজন’
অধ্যাপক মুশতাক খান বলেন, যেহেতু গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে এই সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেজন্য মানুষের প্রত্যাশাও বেশি। মানুষ চায় দ্রুত কিছু পরিবর্তন আসুক। কিন্তু বাস্তবে সেটি সম্ভব নয়। এসব দাবি মেটানোর জন্য ক্ষমতা, প্রয়োজনীয় কাঠামো এবং লোকবল নেই।
‘ওনারা একটা নরমাল সরকারে মতো ব্যবহার করছে, কিন্তু আসলে ওনারা বিপ্লবী সরকারের মতো। তারা ক্ষমতায় এসেছে মানুষের রক্তের ওপর দিয়ে। এখন মানুষ অ্যাকশন দেখতে চায়।’
তিনি বলেন, দ্রুত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য সরকারের উচিত কিছু ‘ইপ্লিমেন্টশন কমিটি’ করা। এতে করে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন দ্রুত হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
‘কোনো কোনো জায়গায় তারা ধীরে সুস্থে এবং চিন্তাভাবনা করে কাজ করার চেষ্টা করছেন। এটা একদিক থেকে ভালো। কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় দ্রুত কিছু অ্যাকশনের প্রয়োজন ছিল’।
সূত্র: বিবিসি বাংলা।
Leave a Reply