গুজবের কবলে দেশ!

একটি ছবিতে ধর্মপ্রাণ পাঁচজন মুসলমান দুই হাত তুলে দোয়া করছেন। মাথায় সাদা টুপি। মুখভর্তি দাড়ি। পরনে তিনজনের সাদা পাঞ্জাবি। অন্য দুজনের পাঞ্জাবির রঙ ভিন্ন। এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক আছে। কিন্তু তারা যেখানে দোয়া করছেন, তার পেছনে দুর্গাপূজার মণ্ডপ। এমন একটি ছবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরব রয়েছে।
শুক্রবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরিন তার ফেসবুকে আলোচিত এ ছবিটি পোস্ট করে লিখেছেন ‘তবে নিচের ছবিটি বানানো। (বুললে তো বুলবেন বুলছে!)’ তার দেওয়া নিচের ছবিতে কী ছিল? সেই ছবিতে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে পাঁচজন দোয়া করছেন।

সামাজিকমাধ্যমে এমন হাজারো গুজব বিভিন্ন সুপরিচিত গণমাধ্যমের আদলে ফটোকার্ড বানিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকেই সেসব কার্ড ফেসবুকে পোস্ট ও শেয়ার করছেন। ছড়িয়ে পড়া আরও একটি গুজব আলোচনায়। যেখানে বলা হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস মঙ্গলবার মধ্যরাতে তার পদ ছেড়েছেন। শুধু তাই নয়, এসব গুজবে বলা হচ্ছে-সেনাবাহিনী নাকি তার বাসভবন ‘যমুনা’ ঘেরাও করে রেখেছিল এবং বিক্ষুব্ধ সেনাসদস্যরা বিভিন্ন বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। ‘সতেরশ কোটি ডলারের বিনিময়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপ আমেরিকার কাছে তুলে দিচ্ছে বাংলাদেশ’-এ গুজবে তোলপাড় শুরু হয়। এ নিয়ে বিভিন্ন নামসর্বস্ব অনলাইনে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। পরে সরকার বিবৃতি দিয়ে জানায়, বিষয়টি গুজব।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত দু’মাসে বাংলাদেশে ব্যাপক মাত্রায় গুজব বেড়েছে। এর একটি অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে, দীর্ঘসময় বাংলাদেশের মানুষ বাকস্বাধীনতা পায়নি এবং গণমাধ্যমগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। তখন সাধারণ মানুষ নিয়মিত গণমাধ্যমের ওপর আস্থা হারিয়েছে। এ দীর্ঘ সময়ে তথ্যের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর মানুষের নির্ভরতা বেড়েছে। সে কারণেই মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা দেখছে, সেটিকেই বিশ্বাস করতে চাইছে। যে অংশ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের বিপক্ষে ছিল, তারা হঠাৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। যারা দেশে অস্থিরতা চাচ্ছে, তারা গুজব ছড়াচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য গণমাধ্যম ও সরকারকে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

ছড়িয়ে পড়া আরও একটি গুজব আলোচনায়। যেখানে বলা হচ্ছে-অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস মঙ্গলবার মধ্যরাতে তার পদ ছেড়েছেন। শুধু তাই নয়, এসব গুজবে বলা হচ্ছে, সেনাবাহিনী নাকি তার বাসভবন ‘যমুনা’ ঘেরাও করে রেখেছিল এবং বিক্ষুব্ধ সেনাসদস্যরা বিভিন্ন বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও এ নিয়ে একটি পোস্ট করেছেন। বুধবার সকালে তিনি তার অফিসিয়াল ফেসবুক প্রোফাইল থেকে লিখেছেন, ‘শুধু চেয়ারই না, প্রধান উপদেষ্টাসহ দেশ ছাড়লেন বাকি উপদেষ্টারাও। সোর্স : চালাইদেন।’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া নানা ধরনের গুজবের সূত্র হিসেবে ‘চালাইদেন’ শব্দটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। তখন আন্দোলনের সমন্বয়কদের অনেকেই মজা করে এ শব্দ নিজেদের ফেসবুক পোস্টে ব্যবহার করেছিলেন। এ ছাড়া বন্যা, উদ্ধার তৎপরতা, ত্রাণ কার্যক্রম, দুর্গাপূজা ঘিরেও মন্দির ও প্রতিমা ভাঙাবিষয়ক কিছু গুজবও বিভিন্ন সময় সামনে এসেছে। এসব গুজব নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মিডিয়া সংবাদ প্রকাশ করছে। গত দুই মাসে এসব ঘটনা আরও বেশি ঘটছে বলে জানাচ্ছে ফ্যাক্টচেকার প্রতিষ্ঠানগুলো।

এ বিষয়ে সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তানভীর হাসান জোহা সময়ের আলোকে বলেন, তথ্য উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে নিয়ে যেমন গুজব ছড়ানো হচ্ছে, তেমনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়েও গুজব ছড়ানো হচ্ছে। গুজব রোধ করতে লাইভে এসে বললাম, তিনি আমার আত্মীয় নন। এভাবে গুজব রোধ করা কঠিন। এজন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয়। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে মেশিন লার্নিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) মাধ্যমে গুজব শনাক্ত এবং তা ছড়ানো বন্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি এ ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে, তাদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ দুটি কাজ করা গেলে গুজব বন্ধ হবে বলে মনে করেন তিনি।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব ভূঁইয়া সময়ের আলোকে বলেন, গুজব একটি ভয়াবহ বিষয়। গুজবে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বড় ক্ষতি হচ্ছে। এটি দ্রুত এবং যথাযথ প্রতিরোধ না করলে বড় ধরনের বিপদ ঘটে যাবে। তিনি মনে করেন, এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে হবে। কারণ গণমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের চেয়ে মানুষ গুজবে বেশি বিশ্বাস করছে। তাই একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে মনে করি, গুজব প্রতিরোধে গণমাধ্যমকেই শক্তিশালী ভূমিকা নিতে হবে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মো. আমানুল্লাহ সময়ের আলোকে বলেন, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা নিয়ে একটি প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল। সঠিক তথ্যপ্রাপ্তির নিশ্চিয়তার পথ সংকুচিত হওয়ার সুযোগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপতথ্যের ওপর মানুষের নির্ভরতা বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে সঠিক তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। একসময় আন্তর্জাতিক চুক্তি, বড় বিনিয়োগের তথ্য গোপন করার চেষ্টা থাকত। তথ্য গোপন করার প্রবণতা থেকেই গুজব ছড়ায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *