বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে নিয়ে মন্তব্য নেতিবাচক মন্তব্য করেই যাচ্ছেন তসলিমা নাসরিন। শুক্রবার (১১ অক্টোবর) ভারতীয় গণমাধ্যম জাগরণে সম্পাদকীয় লেখায় বাংলাদেশ ও ড. ইউনূসকে নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন তিনি।
তসলিমা নাসরিনের লেখাটি তুলে ধরা হলো-
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর দুই মাসের বেশি হয়ে গেছে কিন্তু সেখান থেকে আসা বিরক্তিকর ও উদ্বেগজনক খবর থামছে না। যদি কখনো মোহাম্মদ ইউনূসের সাথে দেখা হয়, আমি জিজ্ঞেস করব কেন এমন হয়? ২০০৫ সালে ফ্রান্সে তার সাথে দেখা হলে তিনি আমাকে বারবার বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে ফিরে এসো।’ আমি বললাম, ‘কীভাবে ফিরব? সেখানকার সরকার আমাকে আসতেও দেবে না। ওটা তোমার দেশ। নিজের দেশে যাওয়া এবং বসবাস করা আপনার জন্মগত অধিকার। এই অধিকারে বাধা দেওয়ার অধিকার কোনো সরকারের নেই। না আমাকে ভিসা দেওয়া হয়েছে, না আমার পাসপোর্ট নবায়ন করা হয়েছে।’ এখন আমি জানতে চাই সে আমার জন্য কি করেছে? হয়তো সে সময় নানা কারণে আমার স্বার্থে তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব হতো না, কিন্তু এখন তিনি ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে আছেন। এখন সবকিছু তার হাতে। সে কি ভয় পেয়েছে? তার চারপাশের মানুষ সবাই মৌলবাদী। এটা আমার চেয়ে সে ভালো জানে। তারা কি ভয় পাচ্ছে যে তাদের নতুন জিহাদি বন্ধুরা আমাকে সাহায্য করার জন্য তাদের উপর রাগান্বিত হতে পারে? এতকিছুর পরেও এই বয়সে তিনি কার সঙ্গে দাঁড়িয়েছেন? তারা কি অনুতপ্ত নয়? প্রবাসে ত্রিশ বছর কাটিয়েছি। বাকি জীবনটাও এভাবেই কেটে যাবে। অন্তত আমি এই গর্বের সাথে মরতে পারব যে আমি আমার আরামের জন্য আমার শত্রুর সাথে কখনই আপস করিনি। সেও কি এভাবে গর্ব করতে পারবে?
সবাই জানে মোহাম্মদ ইউনূস আমার কথার জবাব দেবেন না। কি হচ্ছে বাংলাদেশে? পছন্দ না হওয়া কাউকে হত্যার মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সহ্য করা হচ্ছে না। বিরোধীদের হয় হত্যা করা হচ্ছে নয়তো জেলে ঢোকানো হচ্ছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্ররা তাদের মেধাবী হওয়ার মুখোশ খুলে ফেলেছে। তিনি একজন উজ্জ্বল ছাত্র বা বৈষম্য বিরোধী নন। উল্টো তারা বৈষম্যের পক্ষে। এ কারণে হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে। হাসিনা সরকারের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে জামায়াত-ইসলামি-এনজিও সরকার। এই সরকারের আসল চেহারা জনগণ সামনে। এরা জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন শিবির ও হিযবুত তাহরীর সংগঠনের লোকজন। জার্মানি, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, আমেরিকা, মিশর, জর্ডান, সৌদি আরব, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তানসহ অনেক দেশ হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ করেছে। ভারত সরকারও গতকাল এই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছে। উল্লেখ্য, ইউনূস ক্ষমতায় আসার পর হিযবুত তাহরীরের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। ইউনূস হিযবুত তাহরীরের নেতাদের সঙ্গে আমেরিকায় গিয়েছিলেন। সেখানে এমনই এক নেতা মাহফুজ আলমের ভূয়সী প্রশংসা করে বলছিলেন, বাংলাদেশের গণআন্দোলনের চিত্রনাট্য তিনিই লিখেছেন। এটা স্পষ্ট যে, এই তথাকথিত গণ-আন্দোলন কোন আকস্মিক বিপ্লব নয়।
পরিহাসের বিষয় হল যে আমেরিকা ইসলামিক সন্ত্রাসীদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য কোটি কোটি ডলার ব্যয় করেছে সেই আমেরিকা তথাকথিত বিপ্লবকে সাধুবাদ জানাচ্ছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন খুবই খুশি। মাহফুজ আলম ছাত্রের ছদ্মবেশে পুরো বাংলাদেশকে বোকা বানিয়েছেন আর ইউনূসকে মহান বিপ্লবী আখ্যা দিয়ে জনগণকে বোকা বানাচ্ছেন। সর্বোপরি, তিনি কীভাবে দেখতে পান না যে বাংলাদেশের দুর্গাপূজা প্যান্ডেলে ইসলামী মৌলবাদীরা জিহাদি গান গাইছে। ইউনূস সরকার বাংলাদেশের কারাগারে বন্দী সকল চরমপন্থী ও সন্ত্রাসীদের মুক্তি দেয়। মাত্র কয়েকদিন আগে জঙ্গি সংগঠন জমিয়তুল আনসার ফিল হিন্দাল শরকিয়ার ৩২ সদস্যকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ইউনূস যদি সত্যিই বাংলাদেশকে ভালোবাসতেন, তাহলে সেখানে চলমান মব লিঞ্চিং শেষ করার কথা ভাবতেন।
মনে রাখা দরকার যে, হেনরি কিসিঞ্জার যিনি বাংলাদেশকে ঘৃণা করেন এবং বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলেন, তিনিও নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। ইউনূসও একজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তিনি বাংলাদেশকে খুব ভালোবাসেন। হিজবুল তাহরীর নেতা মাহফুজ আলম কি মোহাম্মদ ইউনুসের বিশেষ সহযোগী নাকি ইউনুস মাহফুজ আলমের বিশেষ সহযোগী? যাই হোক না কেন, এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশে এখনও অরাজকতা বিরাজ করছে। ইউনূস এটাকে পাত্তা দেন না।
বাবার হত্যার প্রতিশোধ নিতে সিংহাসনে আসেন শেখ হাসিনা। তিনি তার পিতার নাম, তার ছবি ও মূর্তি সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়ে মানুষের মন ইসলামে ভরিয়ে দেন। তিনি ভেবেছিলেন যে এটি দেশবাসীর চিন্তাশক্তিকে ভোঁতা করে দেবে এবং তিনি অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকতে উপভোগ করবেন। তিনি কল্পনাও করেননি যে একদিন, যখন ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রভাবে অজ্ঞান হয়ে বহু মানুষ জিহাদী হয়ে যাবে, তখন তাদের মধ্যে কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করা হবে, কিন্তু তাদের সবাই নয়। যে সাপটিকে তিনি লালন-পালন করেছিলেন তার ফণা তোলা মাত্রই তাকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল।
ড. ইউনূস যদি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন, তাহলে তাকেও জিহাদি সাপ কামড়াবে। হাসিনার কাছ থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার পর যত তাড়াতাড়ি তিনি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাবেন ততই তার জন্য মঙ্গল হবে। তাদের মনে রাখতে হবে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। সেই স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার যতই চেষ্টা করা হোক না কেন, তা সফল হবে না। জিহাদীরা শুধু তাদের নামে দেশ চালাচ্ছে না, জামায়াত, শিবির, রাজাকার গ্রুপসহ অন্যান্য মৌলবাদী সংগঠনও সুবিধা পাচ্ছে। এই মানুষগুলো যেকোনো দিন দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়।
Leave a Reply