ধীরে দল গোছানোর লক্ষ্য ‘নেতৃত্বহারা’ আওয়ামী লীগের!

আওয়ামী লীগ, ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থানে পতনের পর ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছে। দলের প্রধান শেখ হাসিনা দেশছাড়া। শীর্ষ প্রায় সব নেতাই পলাতক। কেউ বা জেলে।

টানা ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা দল এখন বিধ্বস্ত।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিভিন্ন মহল থেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করারও দাবি তোলা হয়েছে। ঠিকানাবিহীন স্থান থেকে মাঝেমধ্যে দলের বিবৃতি এলেও প্রকাশ্য কর্মসূচি বলতে গেলে নাই-ই। মিছিল-মিটিং, প্রতিবাদ এমনকি পরিচিত নেতাদের কাউকেই প্রকাশ্যে কোনো দলীয় কর্মকাণ্ড পালন করতে দেখা যাচ্ছে না।

অন্য দলগুলো যেখানে নির্বাচন নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেখানে আওয়ামী লীগ দল হিসেবে কিভাবে সামনে এসে দাঁড়াবে সেই চ্যালেঞ্জে আছে।

এরই মধ্যে সরকার বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ও ১৫ আগস্টের মতো আটটি জাতীয় দিবস বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। গণহত্যায় অভিযুক্ত করে দুদিন আগেই আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ অনেক নেতার নামে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে।

খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, রাজনীতির মাঠে দলীয় অবস্থা, দলীয় চেতনা, কৌশলগত পন্থা সব কিছুতেই একটা কোণঠাসা পরিস্থিতিতে রয়েছে আওয়ামী লীগ।

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে হামলা, মামলা ও আক্রমণের শিকার হওয়ার উত্কণ্ঠা। দলটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করছেন, ১৯৭৫-পরবর্তী আওয়ামী লীগ এ রকম বিপাকে আর কখনো পড়েনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখনকার বাস্তবতা ভিন্ন হলেও আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়াবে। আওয়ামী লীগ জনগণের দল। বাংলার মাটি থেকে আওয়ামী লীগকে উত্খাতের চেষ্টা আগেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে।

কিন্তু এমন চেষ্টা সফল হয়নি, হবেও না।’

জানা যায়, শুধু রাজনীতির মাঠ নয়; ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের রাজনীতির বাইরে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানেও দেখা যাচ্ছে না। কিছু কার্যক্রম নামে-বেনামে শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন বক্তব্য, বিবৃতি আর প্রতিক্রিয়া দেখানো ছাড়া তেমন কোনো কর্মসূচিতে নেই দলটি। এমনকি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নামে এখন পর্যন্ত কোনো বিবৃতি আসেনি। তিনি কোথায় আছেন, তাও জানে না কেউ।

শেখ হাসিনার নামে ২১৭ হত্যা মামলা

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে ‘জুলাই-আগস্ট’ হত্যাকে কেন্দ্র করে মোট ২১৭টি হত্যা মামলা দায়েরের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব মামলায় শেখ হাসিনার সঙ্গে সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের পদধারী বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী, সচিব ও পুলিশ কর্মকর্তা মিলিয়ে মোট ৫৫৪ জনকে আসামি করা হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর বিভিন্ন সময়ে সাবেক মন্ত্রী, এমপি, সচিব, পুলিশ ও সেনবাহিনীর কর্মকর্তাসহ রাজনৈতিক পদধারী ৩৪৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী,অনেক এমপিও রয়েছেন।

প্রধান কার্যালয়ের নিরাপত্তায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন

রাজধানীর ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে অবস্থিত আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক কার্যালয়টি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে আছে। সেখানে ভবঘুরেরা নিয়মিত যাতায়াত করে। প্রায় একই রকম অবস্থায় পরিণত হয়েছে ধানমণ্ডিতে অবস্থিত দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়।

এ ছাড়া বেদখল হয়ে আছে তেজগাঁওয়ে অবস্থিত আওয়ামী লীগের ঢাকা জেলা কার্যালয়। ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় থেকে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের কার্যক্রম পরিচালিত হতো। আর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের কার্যালয় থেকে মূল দলের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। প্রাথমিকভাবে ঢাকার মূল তিন কার্যালয় নিজেদের দখলে নিতে চায় আওয়ামী লীগ।

দলীয় সূত্র বলছে, এরই মধ্যে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ সংস্কারের লক্ষ্যে এবং দলীয় কার্যালয়ের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। গত বুধবার এই আবেদন করা হয়।

ঘুরে দাঁড়াতে মাঠ গোছাতে চায় আ. লীগ

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনুপস্থিতিতে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এমন বাস্তবতায় দলের ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ওপর দায়িত্ব ও ভরসা দুটোই বাড়বে। সেই লক্ষ্যে দলের তৃণমূল পর্যায়ের সৎ ও স্থানীয় পর্যায়ে রোষানলের শিকার তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম হবেন—এমন ব্যক্তিদের ওপর দলের কেন্দ্র থেকে মাঠ গোছানোর বার্তা যাবে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সাংগঠনিক সম্পাদক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশের আইন-শৃঙ্খলা বিশৃঙ্খল হয়ে আছে। আমাদের নেতাকর্মীরা এলাকায় থাকতে পারছেন না। পল্টন থানার এক মামলায় কেন্দ্রীয় কমিটির সবাইকে আসামি করা হয়েছে। বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের জানমালের নিরাপত্তা নেই। পুড়ে যাওয়া কার্যালয়গুলো মেরামত করতে দেওয়া হচ্ছে না। থানায় গিয়ে মামলা করা তো অনেক দূরের কথা, একটা জিডি পর্যন্ত করা যাচ্ছে না।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন যাঁরা ক্ষমতায় তাঁরা মুখে যা বলে মনেও যদি তা ধারণ করে তাহলে আগে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঠিক করুক, রাজনীতির পরিবেশ তৈরি করুক। আর তাঁদের এসবের আয়োজন যদি হয় আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা, তাহলে বলব এটা সম্ভব না।’

সূত্র জানায়, দলীয় কৌশল অনুযায়ী, আত্মগোপনে থাকা নেতারা ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে আসবেন। দেশের বাইরে থেকে কেন্দ্রীয় নেতারা নিজ নিজ এলাকায় যোগাযোগ বাড়াতে শুরু করেছেন। তৃণমূল থেকে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর সুযোগ খোঁজা হচ্ছে। হামলার ঝুঁকি নিয়েই কিছু জায়গায় স্থানীয় নেতারা প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *