পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন সম্ভব? দলগুলোর আপত্তি ও সম্মতি!

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) একটি নির্বাচনি পদ্ধতি, যা রাজনৈতিক দলের ভোটের ভিত্তিতে আসন বণ্টন করে। এ ব্যবস্থায় ভোটের প্রতি অংশগ্রহণের হারে দলগুলোর সংসদীয় আসন নির্ধারণ করা হয়, ফলে ভোটারদের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি দল মোট প্রদত্ত ভোটের ১০ শতাংশ পায়, তবে তারা সংসদের ৩০টি আসনের ১০ শতাংশ বা ৩টি আসন পাবে। বিশ্বব্যাপী পিআর ব্যবস্থার বিভিন্ন ধরনের নির্বাচনি পদ্ধতি রয়েছে, যার মধ্যে মুক্ত, গোপন এবং মিশ্র পদ্ধতি উল্লেখযোগ্য। এই পদ্ধতিগুলি ভোটারদের মতামতকে আরও কার্যকরভাবে প্রতিফলিত করতে সাহায্য করে।

সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বের ১৭০টি দেশের মধ্যে ৯১টি দেশে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ, ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা গত এক দশকে বিভিন্ন সময়ে আনুপাতিক হারে নির্বাচন ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে সুপারিশ করে আসছিল।

তাদের মতে, বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে নানা বিতর্ক যেমন রয়েছে, তেমনি বর্তমান পদ্ধতি ভোটে যে কোন রাজনৈতিক দলের স্বৈরাচারি হয়ে উঠলেও তা রোধ করা যায় না।

নির্বাচন বিশ্লেষক অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদের মতে, বাংলাদেশের নির্বাচন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হলে এ পদ্ধতিতে ভোট চালু করা যায়। সেক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ পদ্ধতিতে কী কী লাভ হয়েছে সেটি বিশ্লেষণ করে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব।

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থার অসুবিধাগুলো আমরা দেখেছি। আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থার অসুবিধা আমরা দেখিনি। এটা চালু করতে সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে। তবে সেটি খুব কঠিন কিছু নয়।

এ পদ্ধতির ত্রুটিপূর্ণ কিছু দিক তুলে ধরে এই সংকটকে ভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করছেন নির্বাচন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

অধ্যাপক আহমেদ বলছিলেন, এই পিআর পদ্ধতিতে ভোটে যে সরকার গঠন হয় সেটি স্থিতিশীল হয় না। কারণ এই পদ্ধতিতে ভোট হলে বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবে না।

যে কারণে আনুপাতিক নির্বাচন করতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমতেই জোর দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।

রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তি ও সম্মতি

সম্প্রতি দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে একটি সেমিনার আয়োজন করে রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি।

সেই সেমিনারে বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টিসহ দেশের অনেকগুলো রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন বিশ্লেষকরা উপস্থিত ছিলেন।

এ সেমিনারে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বড় অংশ বিদ্যমান পদ্ধতির পরিবর্তে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে মত দেন।

ওই দলগুলোর মধ্যে অনেক দলই প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সংলাপে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা চালুরও দাবি জানিয়ে আসছিল।

এ পদ্ধতিতে মধ্য ও ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমত থাকলেও এ নিয়ে আপত্তি আছে অন্যতম বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপির। দলটি শুরু থেকেই বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থাকে সমর্থন করে আসছে জাতীয় নির্বাচনে।

আরেকটি বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে অবশ্য এসব সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

নির্বাচন বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, বিএনপি মনে করে এখন প্রচলিত পদ্ধতিতে ভোট হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন তারাই পাবে। তারা অন্য কাউকে কিছু দিতে চায় না। যে কারণে তারা আনুপাতিক ভোটের বিপক্ষে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু বিএনপি না, অতীতে এই প্রস্তাব আসলেও বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো বড় দুটি দল না চাওয়াতে এই পদ্ধতি চালু হয়নি।

এ প্রশ্নে অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদের মত হচ্ছে, এ ধরনের নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করতে যদি বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলও জনমতের চাপ থাকে তাহলে দুই একটি রাজনৈতিক দল না চাইলেও এ ব্যবস্থায় ভোট করা সম্ভব।

তিনি বলেন, ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর অনেকেই খুব আগ্রহ দেখাচ্ছে এ পদ্ধতিতে দ্রুত ভোট চালুর জন্য। আবার বড় রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে এটা চাইছে না। এখন দুই পক্ষেরই যৌক্তিক জায়গা থেকে চিন্তা করতে হবে।

দীর্ঘদিন রাজতন্ত্রের পতনের পর নেপালে এই পদ্ধতি চালুর উদাহরণ টেনে বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদী স্বৈরশাসন বা একনায়কতন্ত্র রোধে সমাধান হতে পারে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *