কর্মীদের অবিশ্বাস্য ও অসাধারণ নৈপুণ্য, নিরলস প্রচেষ্টা, আন্তরিক সেবা ও সমন্বয়ের দরুন বদলে গেছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সার্বিক চিত্র। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর দেশের অন্যান্য সেক্টরের মতো এখানেও এসেছে পরিবর্তনের হাওয়া। যে ট্রলিম্যান আগে যাত্রীদের এড়িয়ে দূরে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল দিয়ে নখ খুটতেন, এখন তিনি দৌড়ে গিয়ে যাত্রীদের বলছেন, স্যার কিছু লাগবে? কিভাবে সাহায্য করতে পারি/ কোনো সমস্যা থাকলে বলেন।
বিমানকর্মী কিংবা বেবিচক স্টাফ- যিনিই ডিউটিতে থাকেন, তার কাছ থেকেই এমন সুআচরণ মিলছে। যাত্রীরা বিশ্বাস করতে পারছে না এটা সেই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, যেখানে এক সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাগেজের জন্য দাঁড়িয়ে থেকে যাত্রীরা গালিগালাজ করত। ইমিগ্রেশন কাস্টমস হলে হয়রানির শিকার হতেন। এখন আর সেই চিরচেনা রূপ নেই। এই কদিনেই সেটা বদলে গেছে। এখন যাত্রীদের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে- সিভিল এভিয়েশন ও বিমানসহ অন্যান্য সংস্থার সার্বিক পরিষেবার ভূয়সী প্রশংসা। গত এক সপ্তাহ বিমানবন্দরের সরেজমিন তদারকি করে এমনই পরিবর্তন দেখা গেছে।
এই বিস্ময়কর পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে চাইলে ফরিদপুরের কামাল নামের এক যাত্রী বলেন, ‘আগে যেখানে লাগেজ পেতাম দুঘন্টায়, এখন সেটা পেয়েছি এক ঘণ্টায়। আগে যেখানে ট্রলি পাওয়া যেত না, এখন দেখা গেছে ট্রলিম্যান দাঁড়িয়ে ডাকছেন, কিছু লাগবে বলে সহযোগিতায় এগিয়ে আাসেন। আগে যেখানে মাথায় করে লাগেজ নিয়ে ক্যানপি থেকে গোলচক্কর যেতাম, এখন সেখানে পেয়েছি শাটল বাস। আরও পাচ্ছি ফ্রি টেলিফোন সুবিধা, ও ইন্টারনেট কানেকশন। সামনে নাকি আরও সুবিধা আসছে।
রেমিটেন্স যোদ্ধাদের জন্য ভিআইপি লাউঞ্জও সুবিধা দেওয়া হবে, কম পয়সায় খাবারও পাওয়া যাবে, একজন করে লোক যাত্রীর সঙ্গে ভিআইপি লাউঞ্জ পর্যন্ত যেতে পারবে। কাস্টমস চ্যানেলেও এখন ছোটখাটো জিনিস নিয়ে আটকানো কিংবা থামানোর মতো কঠোর আচরণ করে না। সব মিলিয়ে এখন এয়ারপোর্টে ভালো লাগে। আমরা আশা করব এটা যেন ধরে রাখা হয় সব সময়।
এ ধরনের পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে চাইলে এয়ারপোর্টের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম জানিয়েছেন, কিভাবে তিনি বিগত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। কিভাবে যাত্রীদের নিরাপত্তা ও সেবা নিশ্চিত করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনাদের সবার সহযোগিতায় আমরা কাজ করছি। সামনে আরও ভালো কিছু দেখতে পাবেন। একটু ধৈর্য ধরেন। সত্যিকার অর্থেই যাত্রীর নিরাপত্তা ও সেবা নিশ্চিত করাই আমাদের একমাত্র চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলেন, এই বিমানবন্দর দিয়ে গত বছর ১ কোটি ১৭ লাখ যাত্রীকে সেবা দেওয়া হয়েছে। চলতি বছরের শেষে যাত্রীর সংখ্যা আরও বাড়বে। এখানকার আন্তর্জাতিক রুটে বছরে প্রায় ৫৫ হাজার ও অভ্যন্তরীণ রুটে প্রায় ৫৩ হাজার ফ্লাইট পরিচালিত হয়। আন্তর্জাতিক রুটে বছরে প্রায় ৯৫ লাখ এবং অভ্যন্তরীণ রুটে প্রায় ২৫ লাখ যাত্রী যাতয়াত করেন। চাহিদা বেশি থাকায় ফ্লাইটের সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে। ২০২৩ সালে প্রায় ১ কোটি ১৭ লাখ যাত্রী এই বিমানবন্দর ব্যবহার করেছেন। এখন পর্যন্ত ৮৮ শতাংশ যাত্রীর কাছে ১৫ মিনিট থেকে ৬০ মিনিটের মধ্যে লাগেজ ডেলিভারি নিশ্চিত হয়েছে।
লাগেজ বহনের সুবিধার্থে বিমানবন্দরে নতুন সংযোজনের পর ট্রলির সংখ্যা বেড়ে ৩ হাজার ৬০০টিতে দাঁড়িয়েছে। ক্যানোপি থেকে বের হয়ে বহুতল পার্কিং ও রাস্তার পর্যন্ত প্রত্যেক যাত্রীর জন্য ট্রলিতে করে লাগেজ নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাত্রীদের সেবা দিতে বাড়ানো হয়েছে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা যাত্রীদের সেবা দিতে বাড়ানো হয়েছে বিভিন্ন সুযোগ-সবিধা। বিগত দিনে এই বিমানবন্দরে অবতরণ করার পরে যাত্রীদের লাগেজ পেতে বিলম্ব হওয়ার অনেক অভিযোগ ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উঠে এসেছে।
এস অভিযোগ দূর করতে সার্বক্ষণিক তদারকির মাধ্যমে এক ঘণ্টার কম সময়ে যাত্রীদের কাছে লাগেজ ডেলিভারি নিশ্চিত করা হচ্ছে এবং লাগেজ ডেলিভারি পেতে সমস্যা হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধি কর্তৃক তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে।এখন আর কোনো যাত্রীকে মাথায় বহন করতে দেখা যায় না ট্রলি। তাদের যতটা সম্ভব সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে দেখা হয়।
শনিবার রবিবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, এখনকার কাজের ধরনেও আনা হয়েছে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন। আগমন ও বহির্গমন এলাকায় যাত্রীদের তথ্য ও দিকনির্দেশনা প্রদানের লক্ষ্যে নতুন করে হেল্প ডেস্ক স্থাপন করা হয়েছে। যাত্রীদের কথা বিবেচনা করে আগমনী এলাকায় দুটি এবং বহির্গমন এলাকায় তিনটি হেল্প ডেস্কে ৫৪ জন সহকর্মী ২৪ ঘণ্টা বিনামূল্যে যাত্রীদের বিভিন্ন তথ্য ও দিকনির্দেশনা প্রদান করে যাত্রীসেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
যাত্রীদের আকাশপথের যাত্রা আরও নির্ঝঞ্ঝাট করতে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ট্রলির সংখ্যা বাড়ানো অন্যতম। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সহায়তা এবং পৃষ্ঠপোষকতায়, মন্ত্রণালয়ের দিক নির্দেশনায়, বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়ার নেতৃত্বে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ সবগুলো সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ ৪০টি এয়ারলাইন্স এবং অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে সমন্বয় করে যাত্রীদের যাত্রা সহজ করার কাজটি করে যাচ্ছে। পুরনো অনেক চাহিদা এবং সমস্যার কথা বিবেচনা করে সম্প্রতি বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জবাবদিহির নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে।
বিমানবন্দরের সবচেয়ে সমস্যা ছিল সময়মতো লাগেজ না পাওয়া, ট্রলি না পাওয়া, কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনের ঝামেলা, ক্যানপি থেকে কোনো শাটল বাস না থাকা। এখন এসব পূরণ করার জন্য নেওয়া হয়েছে বিবিধ উদ্যোগ। এখন টার্মিনাল থেকে রাস্তা পর্যন্ত লাগেজ বহন করতে বাড়ানো হয়েছে ট্রলির সংখ্যা। সম্প্রতি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ চালু করেছে শাটল বাস সার্ভিস। বিমানবন্দর থেকে কাছাকাছি বাসস্ট্যান্ড, রেল স্টেশনে আসা- যাওয়া সহজ করতে বিআরটিসি কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে এই উদ্যোগটি চালু করা হয়। নামমাত্র ভাড়ায় এসিযুক্ত বাসে যাত্রীরা তাদের লাগেজসহ চলাচল করতে পারেন।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, বিমানবন্দরে কর্মরত সব সংস্থার সদস্য কর্তৃক যাত্রীদের আন্তর্জাতিক মানের সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এখনো পর্যন্ত বিমানবন্দরে কর্মরত ২৮টি ব্যাচের প্রায় ৮০০ সদস্য প্রশিক্ষণ নিয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন এয়ারলাইন্স কর্তৃক যাত্রীদের লাগেজ রেখে আসা বা লেফট বিহাইন্ড রোধে কাজ চলছে। এ লক্ষ্যে যেসব এয়ারলাইন্সের বেশি ‘ লেফট বিহাইন্ড’ সেগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের আগমনী সিটের ক্যাপাসিটি কমিয়ে এনে এবং সংশিষ্ট এয়ারলাইন্সগুলোর সার্বিক সহযোগিতায় লাগেজ ‘লেফট বিহাইন্ড’ সমস্যায় উন্নতি করা হচ্ছে।
এখন লেফট বিহাইন্ডের ৯৯ দশমিক ৮০ শতাংশ লাগেজ যাত্রীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এর আগে যাত্রীদের সুবিধার্থে ১০টি ফ্রি টেলিফোন বুথ ও ফ্রি ওয়াই-ফাইয়ের ব্যবস্থা করেছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। আগমনী যাত্রীদের বিমানবন্দরে অবতরণের পর বিভিন্ন তথ্যসেবা অনলাইনের মাধ্যমে নিতে হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশী সিমকার্ড না থাকায় যাত্রীরা অসুবিধায় পড়েন। তাই বিভিন্ন অপারেটরের সহায়তায় যাত্রীদের ফ্রি ওয়াই-ফাই ব্যবহার করার ব্যবস্থা হয়েছে।
এ বিষয়ে জেদ্দা থেকে আগত কুমিল্লার হালিমা বলেন, শুনেছি আগামীতে নাকি যাত্রীদের জন্য বিমানবন্দরের তৈরি করা হবে বিশেষ লাউঞ্জ। এটা করা হলে আমাদের আর কোনো দুঃখ থাকবে না। বিদেশ থেকে পরিশ্রম করে দেশে ফিরে যদি এয়ারপোর্টে নেমে যদি লাগেজটা কেউ না কাটে, কেউ চুরি করে মাল নিয়ে না যায়, এইটুকু নিশ্চয়তা পাওয়া যায়,তাহলে আর কি লাগে? এটাই তো আমাদের চাওয়া।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল রেমিটেন্স যোদ্ধাদের জন্য প্রবাসীদের জন্য ভিআইপি লাউঝঞ্জ সুিবধা প্রদানের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে যেসব শ্রমিক ভাই- বোন যাচেছন, তাদের জন্য বিমানবন্দরে আলাদা স্পেশাল লাউঞ্জের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে জায়গা ঠিক করেছি, সিভিল এভিয়েশনের সঙ্গে কথা হয়েছে, আশা করি দুই সপ্তাহের মধ্যে হয়ে যাবে। লাউঞ্জ হলে প্রবাসী শ্রমিক ভাই-বোনদের যন্ত্রণা অনেকটা দূর হবে।
এর পাশাপাশি অন্যান্য যে ভিআইপি সুবিধা সেগুলোও থাকবে। বিমানবন্দরে প্রবেশের মুহূর্ত থেকে প্লেনে ওঠার আগ পর্যন্ত যে লাউঞ্জ থাকে, সেই পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে তাদের সঙ্গে একজন লোক থাকবে সহায়তার জন্য। আমরা মনে করি, এটি প্রবাসীদের প্রতি উদারতা নয়, এটি তাদের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা। এটি বহু আগে করা উচিত ছিল।
জানা গেছে, বহুতল কার পার্কিংয়ের একটি ফ্লোর যেখানে আগে কভিড টেস্ট সেন্টার হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল, সেখানেই এই ভিআইপি লাউঞ্জ করা হচ্ছে। যাত্রীদের সঙ্গে আসা দর্শনার্থীরা এয়ারপোর্টে এসে এখানেই অপেক্ষা করতে পারবেন। তাদের জন্য এখানে স্বল্পমূল্যে বিশেষ খাবারেরও সুব্যবস্থা থাকবে। চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়া জানিয়েছেন, আগামী দুসপ্তাহের মধ্যেই এটা চালু করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চলছে।
Leave a Reply