গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের পদত্যাগের পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বয়কটে পড়েছেন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান, আন্দোলনকে বিতর্কিত করার চেষ্টা, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের হুমকি দেওয়া প্রভৃতি অভিযোগে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষককে বয়কট করেছে শিক্ষার্থীরা। যাদের প্রায় সবাই ‘আওয়ামীপন্থী’ শিক্ষক। সেপ্টেম্বরের শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষা, অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম স্বাভাবিক হলেও এসব শিক্ষক অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে ফিরতে পারেননি। তাদের নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
শিক্ষার্থীদের বয়কটের তালিকায় সবচেয়ে এগিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের প্রায় ৮০ জন শিক্ষক অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছেন না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ২০ জন শিক্ষককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। একাধিক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি, শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তোলা ও বিভাগীয় কার্যক্রমে স্বেচ্ছাচারিতাসহ নানা অভিযোগ তুলেছে শিক্ষার্থীরা। অনেককে চাকরিচ্যুত করার দাবিও জানানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্দোলনে সাহস জোগাতে শিক্ষকদের একটি পক্ষ যেমন শিক্ষার্থীদের নানা পরামর্শ দিয়েছে ও সহায়তা করেছে, তেমনি আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল আরেক দল শিক্ষক। তাদের বেশিরভাগই পতিত সরকারের সুবিধাভোগী এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিলেন। তবে কিছু শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান না নিয়ে, অপকর্মে জড়িত না হয়েও বয়কটের শিকার হয়েছেন। আবার নীরব থাকার কারণে অনেক শিক্ষক ক্ষমা চেয়ে ক্লাসে ফিরেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, নিরপরাধ শিক্ষকরা যাতে অন্যায়ের শিকার না হন, সেটি তারা দেখবে।
ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে অবস্থান, আন্দোলনে যেতে বাধা ও হুমকি প্রদান, ছাত্রলীগকে আন্দোলনকারীদের তথ্য দেওয়া, নীল দলের মিছিলে অংশ নেওয়ার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে শিক্ষার্থীরা। এসব শিক্ষক ক্লাসে থাকলে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যাবে বলে জানিয়েছে। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের অন্তত ৮০ জন শিক্ষক বয়কটে পড়েছেন। বিতর্কিত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরালো হলে বিভাগগুলো তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়। কয়েকটি বিভাগে একাধিক শিক্ষক বয়কট হওয়ায় অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ঢাবির আইন বিভাগের চারজন শিক্ষককে বয়কট করা হয়েছে। তারা হলেন- অধ্যাপক রহমতুল্লাহ, অধ্যাপক জামিলা আহমেদ চৌধুরী, প্রভাষক আজহার উদ্দিন ভূঁইয়া, প্রভাষক শাহরিমা তানজিম অর্নি। তাদের ১৩-১৭ ব্যাচের যাবতীয় অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কলা অনুষদের ১১ বিভাগের অন্তত ২৫ জন শিক্ষককে বয়কট করেছে শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের ছয় শিক্ষককে শিক্ষার্থীরা বয়কট করেছে। ব্যাপক অভিযোগ থাকায় অধ্যাপক ড. ফাজরীন হুদাকে সব বিভাগীয় কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আরবি বিভাগের চার শিক্ষককে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান ও হুমকি প্রদানের জন্য আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. ইউসুফের স্থায়ী বহিষ্কার চেয়ে উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
বঙ্গভবনের সামনে সাউন্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণ, সাংবাদিকসহ আহত ৫বঙ্গভবনের সামনে সাউন্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণ, সাংবাদিকসহ আহত ৫
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের আটটি বিভাগে বয়কটে পড়েছেন অন্তত ১৭ শিক্ষক। তাদের অধিকাংশকে ১৮-১৯ সেশন থেকে ২২-২৩ সেশনের যাবতীয় অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। পদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নিলুফার ইয়াসমিন। ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের অন্তত ১৩ জন শিক্ষককে যাবতীয় অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে বর্জন করেছে শিক্ষার্থীরা। জীববিজ্ঞান অনুষদের দুজনকে বয়কট করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি ইনস্টিটিউটের চারজন শিক্ষক বয়কটের শিকার হয়েছেন। শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. ওয়াহিদুজ্জামান চান ও মাহবুবুর রহমান লিটুর বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বয়কটের শিকার কলা অনুষদের এক শিক্ষক বলেন, ‘আমি শুধু আওয়ামীপন্থী হওয়ায় বয়কটের শিকার হলাম। শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি সবসময়।’ একটি ইনস্টিটিউটের এক পরিচালক বলেন, ‘আমি সাতে-পাঁচে কখনো ছিলাম না। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান করেছি এ অভিযোগে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে।’
ঢাবির আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাকে এক মাসের বেশি সময় ধরে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা হয়েছে, ফলে ক্লাসে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ইংরেজি ভাষার পাঁচটি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা আমাকে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে ফেরত নেওয়ার জন্য উপাচার্য মহোদয়ের কাছে আবেদন করলেও তথ্যানুসন্ধান কমিটির পদ্ধতিগত দীর্ঘসূত্রতার কারণে এখনো আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের সুরাহা হয়নি।’
গত ১৫ জুলাই রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও বহিরাগত সন্ত্রাসীরা। এর পরদিন ক্যাম্পাস ছাড়েন তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আওয়ামীপন্থী অনেক শিক্ষক। তারা নিরুদ্দিষ্ট। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ইন্ধনদাতা অভিযোগে তাদের অনেককে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। অভিযুক্ত শিক্ষকদের শাস্তির দাবিও জানায় তারা। অভিযুক্ত ও অবাঞ্ছিত তালিকায় আছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ১৪ জন শিক্ষক।
সরকারি কর্মচারীসহ অন্যান্য কর্মীদের ই-রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলকসরকারি কর্মচারীসহ অন্যান্য কর্মীদের ই-রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক
বিভিন্ন অভিযোগে শিক্ষার্থীরা যাদের অবাঞ্ছিত করেছে তারা হলেন, লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক জেবউন্নেসা; সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক বশির আহমেদ, সহযোগী অধ্যাপক ফিরোজ উল হাসান ও ইখতিয়ার উদ্দিন ভূঁইয়া; দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ; ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মেহদি ইকবাল; নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ইসরাফিল আহমেদ রঙ্গন ও সহকারী অধ্যাপক মহিবুর রউফ শৈবাল; পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক আলমগীর কবির; সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলম ও অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর; পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এএ মামুন; আইন অনুষদের সহকারী অধ্যাপক তাপস কুমার দাস ও সহকারী অধ্যাপক সুপ্রভাত পাল। সহকারী অধ্যাপক মহিবুর রউফ শৈবাল ও অধ্যাপক জেবউন্নেসা বাদে নয়জনের বিরুদ্ধে গত ১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ইন্ধনদাতার অভিযোগে আশুলিয়া থানায় মামলা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সাজ্জাদুল ইসলাম। মামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন কর্মকর্তা ও দুই ছাত্রলীগ নেতাসহ অজ্ঞাতনামা আরও ১৫০ জনকে আসামি করা হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদের বলেন, ‘যেসব শিক্ষক সরাসরি শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, সরকারের সুবিধা ভোগ করে নানা অপকর্ম করেছেন, তাদের বয়কট করেছে শিক্ষার্থীরা। আমরাও তাদের শাস্তি দাবি করছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জুলাই-আগস্ট মাসের আন্দোলন ঘিরে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভও যৌক্তিক। আমরা দেখছি যাদের বয়কট করা হয়েছে তাদের ভূমিকা কী ছিল। আমরা শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দূরত্ব কমানোর চেষ্টা করছি। কেউ সত্যিকারার্থে অন্যায় করে থাকলে তাদের শাস্তি পেতে হবে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণাবৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, ‘বিভিন্ন বিভাগে আন্দোলন কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের ঝামেলার কথা আমাদের কাছে এসেছে। পাঁচটি স্তরে এটি নিরসনের পরিকল্পনা রয়েছে প্রশাসনের। বিভাগ, অনুষদে সমাধান না হলে বিষয়টি সিন্ডিকেট আসবে। তখন অভিযোগের গুরুত্ব বুঝে তদন্ত কমিটি করা হবে। পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগে তাদের অবাঞ্ছিত করেছে। যেসব শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন আমরা শিগগিরই তাদের চিঠি পাঠাব যুক্তি খণ্ডনের জন্য। যাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, তাদের ব্যাপারে রাষ্ট্র যে সিদ্ধান্ত নেবে, সে অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেব।’
Leave a Reply