কুড়িগ্রাম ৪ আসনের আওয়ামী লীগেরে সাবেক সংসদ সদস্য সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন যেন মুকুটহীন রাজা। আর তার রাজ্য জেলার ৩ উপজেলা ( চিলমারী, রৌমারী ও রাজীবপুর)। তিনি এই আসন থেকে দুই বারের সংসদ সদস্য ও একবারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী।
তার এই রাজ্যে গত ১৫ বছরে তিনি জমি দখল, চরদখল, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, চাঁদাবাজি, সরকারি প্রকল্পের কথা বলে কৃষকের জমি আত্নসাৎ, শিক্ষকের নিয়োগের কথা বলে টাকা নেওয়াসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই করেন নি।
গড়ে তুলেছেন সন্ত্রাসীবাহিনীও। আর এই বাহিনী চলত মাদক বিক্রির টাকা দিয়ে। তার নামে রয়েছে সরকারী খাস জমি দখলের অভিযোগও। তার শাসন আমলে নিজ দলীয় নেতাকর্মীরা গৃহছাড়া হয়েছেন।
সরেজমিনে অনুসন্ধানে উঠে এসছে এমন সব তথ্য।
বর্তমানে সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার বাসিন্দা এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি ২০০৮ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়োনে সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালে দায়িত্ব পান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে আদালত তার রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
স্থানীয়রা জানান, সীমান্তে গরু আর মাদকের চোরাকারবারি দিয়ে রোজগার শুরু হয় জাকির হোসেনের। আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও দলীয় মনোনয়ন নিয়ে দুই বার এমপি নির্বাচিত হলে হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। ২০১৯ সালে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর আরো ‘ভয়ংকর’ হয়ে ওঠেন এই আওয়ামী লীগ নেতা।
তার ছত্রছায়ায় সীমান্তে মাদক ও গরু চোরকারবারিসহ তৈরি হয় ত্রাসের রাজত্ব। স্থানীয় হাট নিয়ন্ত্রণ ও নদীতে অগণিত অবৈধ ড্রেজার বসিয়ে বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রকও হয়ে ওঠেন জাকির ও তার সাঙ্গরা। সরেজমিন এসব অভিযোগের সত্যতা মেলে।
খাসের সঙ্গে দখল করেন ব্যক্তির জায়গাও
উপজেলার স্থলবন্দরগামী তুরা রোডের পাশে বঙ্গবন্ধু পত্নী শেখ ফজিলাতুন্নেসার নামে কলেজ প্রতিষ্ঠার নামে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের বিশালাকার জায়গা দখলে নিয়েছেন জাকির হোসেন। তৎসংলগ্ন স্থানীয় কৃষকদের আবাদি জমি দখলে নিয়ে বালু ভরাট করে তৈরি করেছেন পাথর ব্যবসার প্রতিষ্ঠান। আইন আদালত করেও সেই জায়গা পুণরুদ্ধার করতে পারেননি ভুক্তভোগী কৃষকরা। জাকিরের অদম্য ক্ষমতার কাছে তারা যেন অসহায়।
দখলকৃত স্থানে খাসজমি সংলগ্ন একটি জমি কিনেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক জালাল মাস্টার। সড়কের পাশে খাস জমিতে প্রায় ৭ লাখ টাকা খরচ করে মাটি ভরাট করে বাড়ি করেছিলেন। তবে ভাঙনে ভিটাহারা হন এই স্কুল শিক্ষক।
তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমারে ৫ লাখ টাকা ধরাইয়া দিয়া কইলো ঘর সরায় নিতে। সরায় নিলাম। তারপরও আমার রেকর্ডকৃত জমিতে বালু ফেলে দখলে নিছে। জায়গাতেও লোকসান, টাকাতেও লোকসান। কী করমু, তার ক্ষমতার কাছে আমরা টিকতে পারি না। এখানে যে জায়গা দখলে নিছে তার অর্ধেক খাস আর অর্ধেক ব্যক্তিমালিকানাধীন। কারো জমির টাকা দেয় নাই।’
আরেক ভুক্তভোগী বামনের চর গ্রামের কৃষক মহসিন আলী বলেন, ‘মন্ত্রী হওয়ার পর আমাগোরে এহানে অন্তত ১৪/১৫ জন কৃষকের রেকর্ডি জমি সে দখলে নিছে। আমার ৪ কাঠা জমিত বালু ফেইলা বাঁধছে। ওগুলা আবাদ কইরা আমাগো সংসার চলতো। জমিতে ধানের বিচন (বীজ) ফেলছিলাম। হের ওপরে সে বালু ফেলছে। জমির বৈধ কাগজপত্র থাকার পরও আমরা কিছুই করতে পারি নাই। তার কাছে টিকতে পারি না। আমরা জমি ফেরত চাই।’
বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপনের কথা বলে জমি দখল
উপজেলার চর শৌলমারী ইউনিয়নের টোপপাড়া গ্রামে ঈদগাহ মাঠ সংলগ্ন স্থানে সোলার বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপনের নামে প্রতারণা করে কয়েক একর জমি নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে করে নিয়েছেন সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী। বর্তমানে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে জায়গাগুলোর তিনদিক ঘিরে ভেতরে একটি ভবন তৈরি করেছেন।
তখন প্রকাশ্যে মিটিং করে তিনি বলেছিলেন, এখানে বিদ্যুৎ প্লান্ট হবে তোমাদের ছেলে মেয়েদের চাকরি হবে। ওই এলাকার বাসিন্দা সায়েদুল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের এখানে আগে বিদ্যুৎ ছিল না। সে (জাকির) এলাকায় আইসা মানুষজনকে নিয়া মিটিং করে। সৌরবিদ্যুৎ চালু করার নামে মানুষের কাছথেকে দলিল করে নিছে। সৌরবিদ্যুৎ আর হয় নাই। এখন ওইহানে খালি গাঁজা মদের আডডা বসে।’
সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাকিরের বিরুদ্ধে দখল আর ক্ষমতার অপব্যবহারের এমন অনেক অভিযোগ রয়েছে। রৌমারী শহরে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের জায়গা দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ, সদর ইউনিয়নের রৌমারী-ঢাকা সড়কের পাশে ব্যক্তিমালিকানাধীন ও খাস জমি দখলে নিয়ে সরকারি যৌথ মালিকানায় স্ত্রীর নামে ‘শিরি অটো রাইস মিলস্’ তৈরির অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া দাঁতাভাঙা ইউনিয়ন ভূমি অফিস ও তৎসংলগ্ন মাজারের জায়গা দখলেরও অভিযোগ রয়েছে জাকিরের বিরুদ্ধে।
এছাড়াও উপজেলার ১৯১ টি পরিবারকে আশ্রয়ণের ঘর এবং ৭২ টি পরিবারকে সৌর বিদ্যুৎ সুবিধার প্রতিশ্রতি দিয়ে ৬০ লাখ ৭২ হাজার টাকা নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে জাকির এবং তার স্ত্রী ও নিকটাত্মীয় সহ তিন জনের নামে গত ১ সেপ্টেম্বর কুড়িগ্রাম আদালতে মামলা করেছেন মোকছেদ আলী নামে উপজেলার এক বাসিন্দা। এসব অনিয়মের কারণে দলের ভিতরেও তাকে নিয়ে আছে সমালোচনা।
সব জেনেও চুপ ছিল কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ
জাকিরের অপরাদ নিয়ে একাধিকবার উপজেলা আওয়ামী লীগ ও স্থানীয় জনগণ কেন্দ্রীয় নেতাদের অভিযোগ করলেও চুপ ছিলেন তারা। এমন কী প্রধানমন্ত্রীর কাযালয়ের অভিযোগ করেও মেলেনি প্রতিকার। বরং আগ্রাসী হয়েছেন জাকির। জানতে চাইলে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ছাত্রনেতা আবিদ শাহনেওয়াজ তুহিন বলেন, ‘আমরা দলগতভাবে সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের কর্মকান্ড নিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগ বিব্রতবোধ করি। জমি দখল থেকে শুরু করে মাদকের ব্যবসা, মাদক ব্যবসার সিন্ডিকেট, ভাইয়া বাহিনী তৈরি করা সবকিছুই তিনি করেছেন। আমরা দলের হাইকমান্ডকে লিখিতভাবে জানিয়েছিলাম। কিন্তু অজানা কারণে দল ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমার জানা মতে শুধু কুড়িগ্রামে নয়, ঢাকা, রংপুর ও গাইবান্ধাতেও তার সম্পদ রয়েছে। অনুসন্ধান করলে দেশের বাইরেও তার সম্পদের খোঁজ পাওয়া যাবে। দখলই ছিলো তার নেশা। তার বিরুদ্ধে যে দলীয় নেতাকর্মীরা গেছেন তাকেই তিনি মামলা দিয়ে শায়েস্তা করেছেন। আমাকে একাধিক মামলা দিয়ে হয়রানি করিয়েছিল জাকির।’
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জাকির হোসেন। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কারো কোনো জমি দখল করিনি। সব জমির বৈধ কাগজপত্র আছে। আমি কারো এক আনা ক্ষতিও করি নাই। যে অভিযোগ করা হচ্ছে সেগুলো অপপ্রচার।’
Leave a Reply