ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। তখন ছাত্র–জনতার আন্দোলনে গুলি চালানোকে কেন্দ্র করে পুলিশের ওপর ব্যাপক হামলা হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় অনেক থানা ভবন। সপ্তাহখানেক থানায় কোনো পুলিশ ছিল না। পরে পুলিশ ফিরলেও কার্যক্রম সীমিত। এ সুযোগে অপরাধীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে ছিনতাইয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে। যদিও ঢাকা মহানগরে বিভিন্ন অপরাধে কত মামলা হয়েছে, সে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। ভুক্তভোগীদের বেশির ভাগই মামলা করতে থানায় যাচ্ছেন না। কেউ কেউ থানায় গেলেও পুলিশ মামলা নিতে চায় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে ধানমন্ডির ৮/১ নম্বর সড়কে কাকলি স্কুলের সামনে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে রাইয়ান ভূঁইয়া নামের এক শিক্ষার্থী। ওই দিনই ধানমন্ডি থানায় লিখিত অভিযোগ দেন রাইয়ানের মা তাজনুর জাহান; কিন্তু সেটি থানায় মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়নি।
তাজনুর জাহান গণমাধ্যমকে বলেন, তিনি থানায় যাওয়ার পর পুলিশ যেভাবে বলেছে, সেভাবেই অভিযোগ দিয়েছেন। পুলিশ এ ঘটনায় কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এ ঘটনার আইনি প্রতিকার পেতে তিনি থানায় দুবার গিয়েছিলেন। পুলিশকে বারবার বলা হয়েছে, ঘটনাস্থল ও আশপাশের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ যেন দেখা হয়। পুলিশ সেটিও করেনি।
তবে পুলিশের ধানমন্ডি অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) জিসানুল হক দাবি করেন, কোনো ভুক্তভোগী থানায় এলে প্রতিকার না পাওয়ার সুযোগ নেই।
গতকাল সরেজমিন স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাতমসজিদ রোডের ধানমন্ডি ৩/এ এলাকা থেকে শুরু করে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে বিভিন্ন স্থানে মানুষ ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ছে। এর মধ্যে কোনো কোনো স্থানে ওত পেতে থাকা অপরাধীরা, আবার সংঘবদ্ধ কিছু দল মোটরসাইকেল বা গাড়ি নিয়ে ঘুরে ঘুরে ছিনতাই করে থাকে।
গত শনিবার সন্ধ্যার পরপর মিরপুর রোডের ধানমন্ডি ৩২ নম্বর এলাকায় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন তাসরীন শামীমা। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেটি প্রকাশ করেছেন। তাতে তিনি লেখেন, ‘আজ (শনিবার) সন্ধ্যায় এমবিএর ক্লাস শেষ করে ক্যাম্পাস থেকে রিকশা করে বাসায় (মোহাম্মদপুরে) ফিরছিলাম। সাড়ে ৬টা থেকে ৭টার দিকে ৩২–এর কাছাকাছি মিরপুর রোড সিগন্যালে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ি। দুজন ছিনতাইকারী রিকশায় বসে থাকা একটা মেয়ের ওপর হামলা চালায়। রাস্তায় জ্যামে এত মানুষ ছিল, কেউ বাঁচাতে আসেনি! যাই হউক আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার কোনো ক্ষতি হয়নি। মোবাইল নিয়ে টানাহেঁচড়া করলেও আমার চিৎকার–চেঁচামেচিতে শেষ পর্যন্ত ওরা হাল ছেড়ে পালিয়ে যায়।’
তাসরীন গণমাধ্যমকে বলেন, এ ঘটনার পর তিনি বাসা থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছেন। কারণ, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি ও আশপাশের এলাকায় প্রতিনিয়ত মানুষ ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছে বলে শুনতে পারছেন।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধানমন্ডি থানাধীন মিরপুর সড়কের ৩২ নম্বর থেকে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের পদচারী–সেতু (ফুট ওভারব্রিজ) পর্যন্ত এলাকাটি আগে থেকেই ছিনতাইপ্রবণ হিসেবে পরিচিত ছিল। আগে সাধারণত ভোরে ফাঁকা সড়কে ‘টানা পার্টির’ সদস্যরা এ সড়কে সক্রিয় ছিল। এখন সন্ধ্যার পর সড়কটিতে আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারাল অস্ত্র প্রদর্শন করে দলবদ্ধ ছিনতাইকারীরা প্রকাশ্যে ছিনতাই করছে। তারা ছিনতাইয়ের পর মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার অথবা ছোট ট্রাকে (পিকআপে) উঠে পালিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে ঢাকার মোহাম্মদপুরে চলতি মাসে চারটি খুন হয়েছে। ডাকাতি, ছিনতাই ও চুরির ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকটি। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেখানে জেনেভা ক্যাম্পকেন্দ্রিক দুর্বৃত্তদের তৎপরতা বেড়েছে। ঢাকা উদ্যান, বছিলাসহ মোহাম্মদপুরের আরও কয়েকটি এলাকায় আগের পেশাদার ছিনতাইকারীরা ছাড়াও নতুন অপরাধী চক্র গড়ে উঠেছে।
একের পর এক ছিনতাই, ডাকাতি ও চাঁদাবাজির ঘটনায় শনিবার বিকেলে মোহাম্মদপুর থানার সামনে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন এলাকাবাসী। সেখান থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান অগ্রগতির জন্য তাঁরা পুলিশকে তিন দিনের সময় বেঁধে দেন। এরপর শনিবার রাতেই মোহাম্মদপুর, আদাবর ও শেরেবাংলা নগর থানা এলাকায় সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র্যাব যৌথ অভিযান শুরু করে। অভিযানে ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ ও কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ৪৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে গতকাল সকালে যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ছিনতাইপ্রবণ ঢাকা উদ্যান এলাকায় বসানো হয় অস্থায়ী সেনাক্যাম্প।
হঠাৎ মোহাম্মদপুর ও ধানমন্ডি এলাকায় ছিনতাইসহ অপরাধ বেড়ে যাওয়ার কারণ কী—এ বিষয়ে র্যাব-২–এর অধিনায়ক অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোয়াজ্জেম হোসেন ভূঁইয়া গণমাধ্যমকে বলেন, ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুর অঞ্চলে অনেক অপরাধী বাইরে থেকে, বিশেষ করে কেরানীগঞ্জ থেকে এসে অপরাধ করে থাকে। এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে র্যাবের পক্ষ থেকে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি অপরাধীদের গ্রেপ্তারে অভিযানও চালানো হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে অভিযানের কথা বলা হলেও ছিনতাই ও ডাকাতি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে নগরবাসীর মধ্যে। অনেকে মনে করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান, টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি তল্লাশিচৌকি বসালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসত।
সূত্র: প্রথম আলো
Leave a Reply