স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে এবং এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে মানুষের যে আশাভঙ্গ হয়েছিল, গত তিন মাসেও তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এসব লক্ষণ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক বলে উল্লেখ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
শুক্রবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরের ষোলোশহর রেলস্টেশনে আয়োজিত এক সমাবেশে আনু মুহাম্মদ এসব কথা বলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা অধিকার রক্ষা পরিষদের ব্যানারে এই সমাবেশ হয়।
আনু মুহাম্মদ বলেন, কৃষক-শ্রমিকসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থ দেখার মতো রাজনৈতিক সংগঠিত শক্তি বাংলাদেশে তৈরি হয়নি। তৈরি হয়নি বলেই এত বড় একটি মুক্তিযুদ্ধের পরে, লক্ষ লক্ষ মানুষ শহীদ হওয়ার পরেও, বাংলাদেশে শোষক-লুটেরা শ্রেণি আবার নতুন করে তৈরি হয়েছে। নব্বইয়ে গণ-অভ্যুত্থান হলো, এরশাদ গেল, কিন্তু লুটেরা শক্তি আবার ক্ষমতায় থাকল। তিন মাস আগে এত বড় গণ-অভ্যুত্থানের পরেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন কিংবা ভবিষ্যৎ চিন্তায় সেই পরিবর্তনের লক্ষণগুলো দেখা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, আমরা দেখি ছাত্ররা দিনের পর দিন সায়েন্স ল্যাব মোড় অবরোধ করে রাখে, কিন্তু শ্রমিকেরা বকেয়া মজুরির দাবি জানালে আগের সরকারের মতো গুলি করছে, বিভিন্ন অপবাদ দিচ্ছে। বলা হচ্ছে, এরা আওয়ামী লীগের লোকজন। আওয়ামী লীগ বললেই তো হবে না। আওয়ামী লীগ এখানে সুযোগ নিতেই পারে। সুযোগ নিতে সুবিধা তখনই হবে যখন এই সরকার আওয়ামী লীগের মতো ভূমিকা নেবে।
দেশে ঢালাও মামলা হওয়ার কারণে আসল অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছেন উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ বলেন, কিছুদিন আগে বড় বড় অপরাধীদের বেশ কয়েকজন ছাড়া পেয়ে গেল। আমি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রভাবশালী একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, এত বড় বড় অপরাধী ছাড়া কীভাবে পাচ্ছে? তিনি উত্তর দিলেন “আমি কিছু জানি না।” তাহলে কারা জানে? সেটাও তিনি জানেন না। তাহলে সিদ্ধান্ত কীভাবে হচ্ছে?
তিনি বলেন, একদিকে দেখতে পাচ্ছি বড় বড় অপরাধী ছাড়া পাচ্ছে, অপরাধীরা দেশ থেকে পালিয়ে যাচ্ছে; অন্যদিকে এমন অনেকের নামে মামলা হচ্ছে, যাতে মামলার গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।
আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, জবাবদিহি এবং স্বচ্ছতার অভাবে গত সরকার স্বৈরাচারে পরিণত হয়েছিল। বর্তমান সরকারে এই দুটির অভাব কোনোভাবেই গ্রহণ করব না। এখানে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা থাকতে হবে। কীভাবে খুনিরা ছাড়া পেয়ে যায়, সেটির জবাবদিহি থাকতে হবে। কীভাবে মামলাগুলো যথাযথ না হয়ে পাইকারিভাবে হয়, সেটির জবাবদিহি করতে হবে। কেন নিহত ও আহত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি হয় না, এর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা কেন কাজ করছে না, সেটির জবাবদিহি থাকতে হবে। কী কারণে জিনিসপত্রের দাম কমছে না, কাদের কারণে কমছে না, এর জবাবদিহি করতে হবে। এই জবাবদিহি কিংবা স্বচ্ছতার জায়গাটা খুব শক্তিশালীভাবে থাকতে হবে।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা অধিকার রক্ষা পরিষদের আহ্বায়ক আসমা আক্তার। সংগঠনটির সদস্য ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওমর সমুদ্রের সঞ্চালনায় এতে আরও বক্তব্য দেন সংগঠনটির উপদেষ্টা অধ্যাপক তাহুরিন সবুর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক জি এইচ হাবীব, কবি ও সাংবাদিক আহমেদ মুনির, আন্দোলনে চোখ হারানো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ শুভ, গৃহকর্মী নূপুর বেগম প্রমুখ।
সমাবেশে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার, আর্থিক সহযোগিতা ও আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসন, সরকারি খাসজমি উদ্ধার করে ভূমিহীনদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা, গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা ঘোষণা, গৃহকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়াসহ ১০ দফা দাবি জানানো হয়।
Leave a Reply