যে ৩ কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা!

সোমবার দুপুর ১২টার দিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের শত শত শিক্ষার্থী মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা চালান। ছবি : কালের কণ্ঠ
সাম্প্রতিককালে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। কথায় কথায় শিক্ষার্থীরা নেমে আসছেন সড়কে। ভাঙচুর, অবরোধ যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বিঘ্ন ঘটছে লেখাপড়ায়।

এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।

তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তা বড় আকার ধারণ করলেও সমস্যা সমাধানে দক্ষতার পরিচয় দিতে পারছেন না কলেজ অধ্যক্ষরা। সম্প্রতি ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

এ ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার তিন কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকে বসে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর।

শিক্ষার্থীদের ট্রমা কাটাতে প্রত্যেক কলেজে একটি করে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বৈঠকে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিন কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। প্রথমত শিক্ষার্থীরা অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন। তারা কোনো সমস্যায় পড়লে কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ না হয়ে নিজেরাই প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

যৌক্তিক হোক আর অযৌক্তিক হোক কাউকে জিম্মি করে তাদের দাবি আদায় করতে চাচ্ছেন।
দ্বিতীয় কারণ হিসেবে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে স্বার্থান্বেষী কোনো মহল ঢুকে পড়েছে। তারা শিক্ষার্থীদের ভুল বুঝিয়ে ইন্ধন দেওয়ার চেষ্টা করছে। এতে শিক্ষার্থীরা আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ছেন। আর তৃতীয় কারণ—আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানপ্রধানরা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারছেন না।

যেকোনো ইস্যুর প্রাথমিক অবস্থায় হস্তক্ষেপ করে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না কলেজ প্রশাসন। ফলে বড় বড় ঘটনার জন্ম হচ্ছে।

মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক এ বি এম রেজাউল করীম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলাম। আমাদের মনে হয়েছে, শিক্ষার্থীরা এখনো ট্রমার মধ্যে রয়েছে। তাই শুধু এই তিন কলেজেই নয়, দেশের সব কলেজেই একটি করে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি। সেই কমিটি শিক্ষার্থীদের ট্রমা কাটাতে করণীয় ঠিক করবে ও কলেজ কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে। শিক্ষার্থীদের মানসিক প্রশান্তি ফিরিয়ে কিভাবে ক্লাসমুখী করা যায়, সে লক্ষ্যে এ কমিটি কাজ করবে।’

অধ্যাপক এ বি এম রেজাউল করীম শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমরা অনেক ভালো কাজ করেছ। এখন আমি বলব, তোমরা ক্লাসে ফিরে যাও। পড়ালেখায় মনোনিবেশ করো। কোনো সমস্যা থাকলে কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করো। তারা তা সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।’

জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম ঘটনা ঘটে এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষা বাতিলের আন্দোলন ঘিরে। কিছু শিক্ষার্থী সচিবালয়ে ঢুকে আন্দোলন করলে পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত আসে। এতে অন্যান্য পর্যায়ের শিক্ষার্থীরাও মনে করতে থাকে, আন্দোলন করলে দাবি আদায় করা সম্ভব।

এ ছাড়া গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে আন্দোলনের মাধ্যমে স্কুল ও কলেজের প্রধানদের পদত্যাগে বাধ্য করেন শিক্ষার্থীরা। এ ব্যাপারে বিবৃতি ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব পালন করেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর মাউশি অধিদপ্তর ছিল একেবারেই নীরব।

এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা পৃথক বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে রাজধানীর রাজপথ অবরোধ করে একাধিকবার আন্দোলনে নামেন। সবচেয়ে কঠোর আন্দোলন করেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারা সড়ক অবরোধের পাশাপাশি রেলপথও অবরোধ করে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য আইন প্রণয়নের প্রয়োজন রয়েছে, যা জাতীয় সংসদ কর্তৃক পাস হতে হয়। কিন্তু এখন দেশের সংসদ নেই। ফলে সরকার ইচ্ছা করলেও এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুযোগ নেই। যেসব শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে পড়ছেন ও আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত তারা যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী। কিন্তু তাদের এই বিষয়টি বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে কলেজ প্রশাসন।

সম্প্রতি রাজধানীর ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা বাসে ওঠাকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের সংঘর্ষে জড়ালে সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও নিউ মার্কেট এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সিটি কলেজ সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ রাখা হয়। শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করতে পারেনি দুই কলেজের প্রশাসন।

সবশেষ ঘটনা গত রবি ও সোমবারের। পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের একজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বড় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা অন্যান্য কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে গত রবিবার হাসপাতালে আক্রমণ চালান। এরপর তারা পাশেই অবস্থিত সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার ওই দুই কলেজের শিক্ষার্থীরা মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে ভাঙচুর করেন। এতে ডেমরা এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠান প্রধানই তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *