পিলখানা হত্যাকাণ্ডে ভারত জড়িত ছিল, তা ঘটনার ক’দিনের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে যায়। যেসব অফিসার বেঁচে ফিরেছিলেন, তাদের পরিবারের সদস্য ও ৪৬ ব্রিগেডসহ অন্যান্য ব্রিগেডের যেসব অফিসার পরে রিকভারি অপারেশনে গিয়েছিলেন, তারা এসব বিষয়ে পরবর্তী সময়ে অনেক তথ্য প্রকাশ করেছেন। সেদিন সেনাকুঞ্জে শেখ হাসিনার সঙ্গে মিটিংয়েই একাধিক সিনিয়র অফিসার সংক্ষুব্ধ জুনিয়রদের ধমক দিয়ে চুপ থাকতে হুকুম দেন।
এ সময় হুমকি দিয়ে সংক্ষুব্ধদের উদ্দেশে বলা হয়, আক্রমণের জন্য ইন্ডিয়ান ফোর্স রেডি, সাবধানে কথা বলো। পিলখানা ম্যাসাকারের পর ভারত শেখ হাসিনাকে রেসকিউ মিশনের প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছিল।
পরে ওইদিন সংক্ষুব্ধ সেনাদের কাউকে কাউকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা হয়; আবার কাউকে দেওয়া হয় বাধ্যতামূলক অবসর। কাউকে কাউকে নির্যাতনও করা হয়েছে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশে ভারতের আধিপত্যবাদ জেঁকে বসে, ৩৬ জুলাইয়ের পর আধিপত্যবাদের এ শৃঙ্খল ভেঙে গেছে।
সম্প্রতি আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় আমার দেশ-এর সঙ্গে জুমে যুক্ত হয়ে এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক। যিনি মেজর জিয়াউল নামেই বেশি পরিচিত। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে তার নামটি উঠে আসে গণমাধ্যমে। ফ্যাসিবাদী সরকারের বয়ান ও আওয়ামী মিডিয়ার প্রচারণা অনুযায়ী জিয়াউল হলেন ‘দুর্ধর্ষ জঙ্গি’।
২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন অফিসাররা এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, তারা একটি অভ্যুত্থান ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। কথিত সেই অভ্যুত্থানের সঙ্গেও উঠে এসেছিল তার নাম।
কখনও তাকে বলা হয়েছে, নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরিরের নেতা; আবার কখনও বলা হয়েছে কথিত আনসার উল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যদের সামরিক ট্রেনিংদাতা। দেশের সরকারি বাহিনীগুলো দিয়ে জঙ্গি নাটক সাজিয়ে প্রচারণা চালানো হতো মেজর জিয়াউল ট্রেনিং দিয়েছেন তাদের। এক পর্যায়ে জিয়াউলকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৪০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
জিয়াউল হক সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার মোস্তফাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সৈয়দ জিল্লুল হক একজন ব্যবসায়ী। বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির ৪১তম দীর্ঘ কোর্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন জিয়াউল। সিলেট ক্যাডেট কলেজের এ ছাত্র সেনাবাহিনীতে প্রথম ধাপেই ট্রেনিং শেষ করে সর্বোচ্চ সম্মান ‘সোর্ড অব অনার’ লাভ করেছিলেন। তিনি মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে পড়াশোনা করেন।
সেনাবাহিনীতে কমিশন পাওয়ার পর তিনি পার্বত্য অঞ্চলে ২৬ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে প্রায় দেড় বছর ছিলেন। তারপর ময়মনসিংহে ইউনিটসহ পোস্টিং হয়। পরে খাগড়াছড়িতে এবং বান্দরবানে তার ইউনিটের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকেই সেনাবাহিনীর এ ব্রিলিয়্যান্ট অফিসার নিখোঁজ ছিলেন।
নিখোঁজ জিয়াউলকে নিয়ে ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি আমার দেশ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলÑ ‘মেজর জিয়াকে নিয়ে রহস্য’ শিরোনামে। জুমে আমার দেশ-এর সঙ্গে মেজর জিয়াউল পুরোনো দিনের কথা বলেছেন প্রাণ খুলে। জানিয়েছেন তাকে অপহরণের চেষ্টা ও অপহরণকারী সেনাদের বোকা বানিয়ে পালিয়ে বাঁচার কৌশল সম্পর্কে।
কেন জিয়াউলকে সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছিল, সে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল তার কাছে। জিয়াউল তখন অনেক অজানা কথা বলেন। তিনি বলেন, ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পিলখানায় সেনা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে সেনাবাহিনীর অফিসাররা ছিলেন সংক্ষুব্ধ। পরবর্তী সময়ে সংক্ষুব্ধ অফিসারদের সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত করা হচ্ছিল।
জিয়াউলের ভাষ্য অনুযায়ী, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (র) ও ডিজিএফআইয়ের সমন্বিত প্রচেষ্টায় সে সময়ে দেশপ্রেমিক অনেক সামরিক অফিসারকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তার দাবি, অপারেশন স্টিংয়ের মতো কৌশল প্রয়োগ করে ৬০-৭০ জন অফিসারকে চাকরিচ্যুত করার পাশাপাশি অনেককে অন্তরীণ করেও রাখা হয়েছিল।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইজিপি বরাবর মেজর জিয়াউল তার মামলা প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করে চিঠি দিয়েছেন। চিঠির অনুলিপি আমার দেশ-এর সংগ্রহে রয়েছে।
সেনাবাহিনীকে নিয়ে ‘ভারতীয় নীলনকশা’
মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক বলেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দিনের পর দিন ভারতীয় প্রেসক্রিপশনে অপারেশনাল আর্মি থেকে সেরিমনিয়াল আর্মিতে পরিণত করা হয়েছে। এখন ১২ মাসে ১৩ পার্বণ পালিত হয়। দেখা যায়, অপারেশনাল ও ইফেক্টিভ কাজকর্ম কম। কিন্তু অন্যান্য যেসব কাজে ইমপ্যাক্ট নেই, সেগুলোতে জোর দেওয়া হয়। এটি ভারতেরই একটি পলিসি। ধাপে ধাপে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে যাতে অকার্যকর করা যায়, ভারতীয় পরিকল্পনাতেই এমনটা হচ্ছিল।
শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ভারতীয় আধিপত্যের বিষয়টি নিয়ে আপনার এমন ব্যাখ্যার পেছনে যৌক্তিক কী কারণ থাকতে পারে?
জবাবে জিয়াউল বলেন, মূল কারণ যদি বলি, বাংলাদেশের শত্রুরাষ্ট্র কে? প্রথম পয়েন্ট হবে এটি। কারণ বাংলাদেশ আর্মিকে অপারেশনাল আর্মি থেকে একটা সেরিমনিয়াল আর্মিতে পরিণত করে এর কার্যকারিতা কমিয়ে দিলে লাভ কার? কারা এই পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে আর্মির এত অফিসারদের শহীদ করে দিয়েছে। কারা আর্মির অফিসারদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অনাস্থা সৃষ্টি করলো সৈনিকদের মধ্যে, এমনকি বিডিআরের মধ্যে?
এটা তো ২০০৯ সালে পিলখানা গণহত্যার আগে থেকেই সবকিছু স্পষ্ট। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যেসব ফোর্স কাজ করে, তাদের দুর্বল করাই ছিল নরমাল স্ট্র্যাটেজি। ডিপ্লোমেটিক্যালি এবং এ দেশীয় এজেন্টদের মাধ্যমে এই কাজটি করা হচ্ছিল। বাংলাদেশের আর্মি ও দেশের মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধের যে চিন্তা-চেতনা আছে, এ দুটো ফোর্সকে দুর্বল করার চেষ্টা করেছে ভারত।
সেনাবাহিনীতে জঙ্গিবাদের প্রচার চালিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারার অপচেষ্টা করা হয়েছে। অনেক আগে থেকেই তো তারা ডিক্লেয়ার করে রেখেছে অখণ্ড ভারতের ধারণা। নেহরু ডকট্রিনেও এটা আছে। বিজেপির প্রজেক্টও এটা। তাদের সিনিয়র পলিটিক্যাল লিডাররা এটা প্রকাশ্যেই বলেন।
তাদের পার্লামেন্টেও তারা অখণ্ড ভারতের মানচিত্র রেখেছে এবং তারা এটা নিয়ে সব সময় কাজ করে, কথা বলে। তারা ক্রমাগতভাবে এর পেছনে কাজ করে যাচ্ছে। তারা অনেক সিরিয়াস। এটাকে শুধু ‘রাজনৈতিক কথার কথা’ বলে মনে না করে সিরিয়াসলি ভাবতে হবে। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার জন্য বাংলাদেশ আর্মিকে নন অপারেশনাল করার প্রসেস সব সময়ই চালিয়েছে তারা এবং এটা ভারতীয় আধিপত্যবাদেরই একটি অংশ।
আপনার কথার যদি সামারি করা হয়, তাহলে ভারতের ষড়যন্ত্রেই বাংলাদেশ আর্মিকে নন অপারেশনাল করার একটা প্রক্রিয়া চলছিল… এটাই কী বলতে চাইছেন?
উত্তরে জিয়াউল বলেনÑজি, অবশ্যই। প্রক্রিয়া চলছিল এবং আমি বলতে চাই এখনও কিছুটা চলছে। এখন যে তা শেষ হয়ে গেছে এমন নয়। অপারেশনাল কাজের চেয়ে নন অপারেশনাল কাজ বেশি সেনাবাহিনীতে।
পিলখানা হত্যাকাণ্ড ও ভারতের জড়িত থাকা প্রসঙ্গ
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সময় আপনি কোন দায়িত্বে ছিলেন এবং আপনার ওয়ার্কিং স্টেশন কোথায় ছিল?
জবাবে জিয়াউল বলেন, তখন আমি এমআইএসটিতে ছিলাম। এমআইএসটিতে স্টুডেন্ট অফিসার্স ছিলাম। আমি তখন বনানী ক্যান্টনমেন্টে থাকতাম। নেভি হেডকোয়ার্টারের পাশেই এটি। এরপর সেনাকুঞ্জে যে মিটিং হয়েছিল, সেখানে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসেছিলেন। সেই মিটিংয়ে আমি নিজেও ছিলাম। তার পরবর্তী সব ইভেন্ট দেখেছি। সিএমএইচে যখন একের পর এক সেনাকর্মকর্তার লাশ আসছিল, সেগুলোও দেখেছি, রিসিভ করেছি। পুরো ঘটনা আমাদের চোখের সামনেই ঘটেছে।
আপনারা কি বিশ্বাস করতেন পিলখানা হত্যাকাণ্ডে ভারত জড়িত?
জবাবে জিয়াউল বলেন, এটা তো ঘটনার কদিনের মধ্যেই পরিষ্কার হয়েছিল। যেসব অফিসার বেঁচে ফিরেছিলেন, তাদের পরিবারের সদস্যরা ও ৪৬ ব্রিগেডসহ অন্যান্য ব্রিগেডের যেসব অফিসার পরে রিকভারির অপারেশনে গিয়েছিলেন, তারা এসব বিষয়ে পরবর্তী সময়ে অনেক তথ্য প্রকাশ করেছেন। সবার কাছ থেকেই ইনফরমেশন আমরা তখনই জানতে পারছিলাম।
এমনকি আমি যে বললাম, সেনাকুঞ্জে মিটিংটি হয়েছিল, সেখানেও সিনিয়র অফিসাররা বলছিলেন, চুপচাপ থাকো; কারণ অলরেডি ইনডিয়ান আর্মি-এয়ারফোর্স রেডি। সাবধানে কথা বলো। ইন্টারভেন (হস্তক্ষেপ) করার জন্য তারা রেডি। সুতরাং এই লেভেলের ভয় আমাদের তখনই দেখানো হয়েছিল।
জিয়াউল আরও বলেন, সেদিন সেনাকুঞ্জে ওই মিটিংয়েই একাধিক সিনিয়র অফিসার আমাদের বলতে লাগলেন, দেখ ভাই, আমাদের চুপ থাকতে হবে। বেশি কিছু করা যাবে না। বেশি উত্তেজিত হওয়া যাবে না। কারণ, ভারত তো অলরেডি তাদের এয়ারফোর্স রেডি করে রেখেছে। তারা কিন্তু যে কোনো সময় আসতে পারে। এটি হয়তো শেখ হাসিনাকে রেসকিউ মিশনের প্রস্তুতি ছিল তাদের।
তিনি আরও বলেন, তারা (ভারত) সরাসরি বাংলাদেশে ইন্টারভেনশনে রেডি ছিল- এটা আমি বলব না। বাট কিলিং মিশনে জড়িত ছিল এবং ভারতীয় কমান্ডোরা যে এসেছিল, তারা যে বের হয়ে গেছে এবং আলাদা পিকআপ ও মাইক্রোবাসে যে তাদের বের করা হয়েছিলÑএসব ঘটনা তো আমাদের সামনে হয়েছে।
সব অফিসারের সামনেই। এমনকি ক্যাপ্টেন সুহায়েল বা অন্য যে অফিসাররা ছিলেন আমাদের এ ঘটনার কোর্ট অব ইনকোয়ারিতে, যাচাই-বাছাই কমিটিতে, তারা অফিসিয়াল ফরমাল রিপোর্ট জমা দিতে পারেননি। ব্রিগেডিয়ার হাসান নাসির স্যার ছিলেন একটি কোর্ট অব ইনকোয়ারিতে। কিন্তু তার মতামত তিনি দিতে পারেননি। ফাইনালি সেই কমিটি থেকে রিজাইন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এখন এই ইস্যু নিয়ে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সরব।
এসব ঘটনায় বিক্ষুব্ধ অফিসারদের ভাগ্যে কি ঘটেছিল?
এমন প্রশ্নের জবাবে জিয়াউল বলেন, যেসব অফিসার এসব শোনার পর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেননি, প্রটেস্ট করেছেন, পতিত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি তর্ক করেছেন, তাদের অনেককেই পরে চাকরি থেকে বের করে দেওয়া হয়। ইস্তফা দিতে বাধ্য করা হয়। কাউকে কাউকে বাধ্যতামূলক অবসরেও পাঠানো হয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, যেসব অফিসার খুব অ্যাকটিভ ছিলেন, তাদের ডিজিএফআইতে নিয়ে গুম রেখে পায়ের নখ তুলে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়েছে এবং সেখানে ভারতীয় ‘র’-এর অফিসাররা ছিলেন। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেসব সেনা অফিসার তথ্য দিচ্ছেন। এসব ঘটনা আমরা তখন থেকেই জানি।
সে ঘটনায় ভারতের ইনভলভমেন্ট খুবই ক্লিয়ার এবং সাম্প্রতিক সময়ে আমার ক্লাসমেট মেজর নুরের স্ত্রী গণমাধ্যমে বলেছেন যে, বিডিআর গণহত্যার সময় অনেকে হিন্দিতে কথা বলে যাচাই করেছে এটা ছেলে, নাকি মেয়ে। মানে মুসলমানের ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখবে না। তখন অনেকেই চাকরির ভয়ে বা প্রমোশনের ভয়ে কথা বলেননি। চুপচাপ ছিলেন। কিন্তু সবাই তো আর চাকরির মায়া করেন না। সবাই তো আর গোলামির জীবন পছন্দ করেন না। যারা গোলামির জীবন পছন্দ করেন না, যাদের সাহস আছে, ব্যক্তিত্ব আছে, তারা কথা বলেছিলেন এবং তারা আলটিমেটলি সাফার করেছেন।
অভ্যুত্থান চেষ্টা ও গুম
কথিত ব্যর্থ অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জিয়াউল বলেন, সম্প্রতি আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আমি পৃথক আবেদন জমা দিয়েছি। তাতে সেই দিনগুলোর পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছি। পিলখানার ঘটনায় ভারতীয় ফোর্স, বাংলাদেশের একদল বিশ্বাসঘাতক অফিসার এবং ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ ইনভলভ ছিল। এগুলো জানার পর যারা প্রতিবাদে মুখর ছিলেন, তাদের আলটিমেটলি একজন একজন করে বাহিনী থেকে আউট করা হয়।
আমরা যারা ভোকাল ছিলাম বা এক কথায় এ ঘটনা মেনে নিতে পারিনি এবং বাংলাদেশে ভারত রাজত্ব করবেÑএটা আমরা যারা মেনে নিতে পারিনি, তাদের সবাইকে তারা আস্তে আস্তে তালিকাভুক্ত করে। এরপর ধীরে ধীরে আউট করার চেষ্টা করে। মাঝে আরও কিছু ঘটনাক্রম আছে।
আমাকে সাভার এলাকার আশপাশ থেকে অপহরণ করে ডিজিএফআইয়ের হেডকোয়ার্টারে রাখে। দুদিন আমাকে রাখা হয় এবং বেশকিছু জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। যদিও আমি ইনফরমেশন ফ্লাডের মাধ্যমে তাদের কনফিউজড করে ফেলেছিলাম। সেখানে কিছুটা নির্যাতন করা হয়। নিজেকে তাদের হাত থেকে বাঁচাতে কিছু পরিকল্পনা ছিল আমার। তাদের বলি, তথ্যসংবলিত একটি পেনড্রাইভ আমি সাভার বাজারের কাছে ফেলে এসেছি। সেটা বের করলে আরও তথ্য দিতে পারব। আমার ফলস ইনফরমেশন ফ্লাডিং দেখে ওরা ভেবেছিল আমি খুব হেলপফুল হয়ে গেছি। তারা আমাকে সাভারে নিয়ে যায়। সেখানে জনসমাগম ছিল আর আমি কৌশলে সেখান থেকে সটকে পড়ি।
গুম হওয়া নিয়ে ২০১২ সালে আমার দেশ-এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে জিয়াউল বলেন, আমার দেশ ছাড়া আর কোনো মিডিয়া সেদিন রিপোর্ট করেনি। সবই ভারতের মিডিয়া, গদি মিডিয়া। সবই হাসিনার মিডিয়া ছিল। এসব মিডিয়া হা-করে তাকিয়ে ছিল ডিজিএফআই কী বলে। এদের ডিজিএফআইয়ের মিডিয়াও বলা যায়। আপনারা (আমার দেশ) ছিলেন ব্যতিক্রম।
জিয়াউল বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর ভারতের আধিপত্যবাদ যে জেঁকে বসেছে, সেটি অনেক অফিসার মেনে নিতে পারেননি। যারা মেনে নিতে পারেননি, তাদের ধীরে ধীরে আর্মি থেকে আউট করা হয়। আমরা কেউ কেউ ভাবছিলাম কীভাবে এই ভারতীয় প্রক্সি গভর্নমেন্ট থেকে দেশের স্বাধীনতাকে আবার উদ্ধার করা যায়। আমাদের হারানো স্বাধীনতা কীভাবে ফিরে পাওয়া যায়। আমাদের স্বাধীনতা ডিজিটালি চুরি হয়ে গিয়েছিল। আমি বলব, এটি আসলে ছিল ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’। যেহেতু এটা প্রক্সি সরকার ছিল, আমরা ডিজিটাল ইন্ডিয়া ছিলাম… ৩৬ জুলাইয়ের পর আমরা আলহামদুলিল্লাহ্ আবার অরিজিনাল বাংলাদেশ হয়েছি।
ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান এবং অপারেশন স্টিং
জিয়াউল বলেন, ভারতের পরিকল্পনাতেই সব কাজ চলছিল। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে এটি পুরোটাই পরিষ্কার হয়ে যায়। তখন ডিজিএফআই ও ‘র’ মিলে একটি বড় স্টিং অপারেশনেরও চিন্তা করে। বাকি যে অফিসাররা আছেন, যারা দেশপ্রেমিক আর যারা টাকার জন্য নিজেদের বিকিয়ে দেননি বা যারা ভারতের হানিট্র্যাপে পড়ে যাবেন না— এরকম অফিসারদের আউট না করলে তো তারা বাংলাদেশকে এই যে ১৫ বছর শাসন করেছিল, তা করতে পারত না।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডে যদি তারা সেসব অফিসারকে হত্যা না করত, তাহলে তো ভারতের এই এজেন্সি রান করতে পারত না বাংলাদেশে। সুতরাং সেই স্টিং অপারেশনের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশে অনেক অফিসারকে (প্রায় ৭০-৮০ জন) তাদের ফাঁদে ফেলে ফাঁসিয়ে দেয়।
তিনি আরও বলেন, আমরা তো আসলে ১০-১৫ জন অফিসার ছিলাম। আমার ইউনিটের একজন অফিসার ছিলেন লে. কর্নেল এহসান ইউসুফ। তার মাধ্যমে তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। আমি শিওর নই উনি সেই প্লটের অংশ কি না। যদিও এটা নিয়ে বেশ কথা আছে।
কিন্তু আমি বেশ সন্দিহান যে, উনি নিজেই ডিজিএফআই ও ‘র’-এর পরিকল্পনায় কাজ করেছিলেন, নাকি নিজেই ফেঁসে গেছেন। ফাইনালি যেটা হয়েছে, সেই স্টিং অপারেশনের কারণে ওরা অনেককে ফাঁসিয়ে দেয় এবং এই স্টিং অপারেশনের পর বাকি সব অফিসারকে যখন ওরা কল করে, তখন আমাকেও লগ এরিয়াতে কল করে।
তখন আমরা বিষয়টি পাবলিকের কাছে নিয়ে আসা উচিত বলে সিদ্ধান্ত নিই। আমরা কিছু করতে পারিনি। আমরা চাচ্ছিলাম দেশকে কীভাবে উদ্ধার করা যায়; কিন্তু সেটা তো করতে পারিনি এই স্টিং অপারেশনের কারণে। আমরা তখনও ভারতীয় আধিপত্যবাদকে ঠিকঠাক বুঝতে পারিনি।
নিজেরাও তখন ইয়াং ছিলাম। তাদের পাওয়ার অনেক ছিল। আলটিমেটলি আমরা ফেইল করেছিলাম। পরে আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি আনার কারণে তারা বাধ্য হয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছিল। তখন পুরো দোষটা আমাদের অফিসারদের ওপর চাপানো হয়। আসলে বেশিরভাগ অফিসারকেই তারা তাদের ফাঁদে ফেলে ফাঁসিয়ে দেয়।
তাহলে কি সেটা অভ্যুত্থান চেষ্টা ছিল না?
এমন প্রশ্নের জবাবে জিয়াউল বলেন, আমরা দেশের জন্য জীবন দিতে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু একই সময়ে ডিজিএফআই ও ‘র’-এর তরফ থেকে একটা ফাঁদ বা স্টিং অপারেশন চলেছিল। ফলে জিনিসটা (অভ্যুত্থান চেষ্টা) কীভাবে নস্যাৎ হয়ে গেল, এটা এখনও শিওর নই। এটা যাচাই-বাছাই করতে হবে। কারণ, আমি এখনও এনাফ ইনফরমেশন জানি না। বাকি সবার সঙ্গে যোগাযোগও নেই।
আত্মগোপনে যাওয়ার পর আপনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনে যুক্ত থাকার অভিযোগ আনা হয়- এমন প্রশ্নের জবাবে জিয়াউল বলেন, এক কথায় বলা যায় ভারতীয় হেজেমনি প্লাস বিগত ফ্যাসিস্ট প্রক্সি সরকার এ দুটোর কমন একটা কার্ড ছিল ‘জঙ্গি কার্ড’। এটি ওয়ার অন টেররের কার্ড। এটি দিয়ে ওয়েস্টার্ন দেশগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে চেয়েছিল।
একই সময় বাংলাদেশে যত ইসলামিক দল আছে, তাদের যাতে চাপে রাখা যায়, এটা ছিল তাদের কৌশল। যত বেশি জঙ্গি মারতে পারবে, তত বেশি ইসলামিক দলগুলোকে চাপে রাখতে পারবে। জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম বা অন্যান্য যত ইসলামি দল আছে, তাদের বলতে পারবে ‘তোমরা জঙ্গি’- এটা বলে তাদের আটকে রাখা। এটা ছিল তাদের মূল কৌশল।
তিনি আরও বলেন, প্রেস কনফারেন্স করে তারা প্রথমে আমাকে হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলেছিল। পরে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নেতা বলে প্রচার চালায়।
আপনাকে জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার কারণ কী?
জিয়াউল বলেন, আমি যেহেতু আর্মিতে ছিলাম, তাই একজন আর্মি অফিসারকে যদি জঙ্গি ট্যাগ দেওয়া যায়, তাহলে পুরো আর্মিকে কিন্তু ব্যাশ ডাউন করা যায়। আর্মি অফিসার যারা আছেন, তারা যেন ধর্মীয় প্র্যাকটিস করতে না পারেন, যেমন নামাজ পড়া, রোজা রাখা, দাড়ি রাখাÑএসব বেসিক ধর্মীয় বিধান পালনের কাজগুলাকে নেগেটিভলি দেখা হতো সব সময়। আমাকে যত বেশি মিডিয়াতে ব্যাশিং করতে পারবে, তত বেশি আর্মিকে চাপে রাখা যাবে।
কোনো কোনো অফিসারের মুখে শুনেছি, কেউ একটু রিলিজিয়াস হলে তাকে বলা হতো তুমি কী জিয়াউলের মতো হতে চাও। এটা একটা ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামভীতি ক্রিয়েট করার কৌশল। একাধিক আর্মি অফিসারকে যদি জঙ্গি ট্যাগ দেওয়া যায় এবং বারবার মিডিয়াতে আনা যায়, একেকবার একেক দলের নামে ট্যাগ দেওয়া যায়, তাহলে বাইরের সব ইসলামপন্থি দলকেও চাপে রাখা খুব সহজ। আর আর্মির ভেতরে আর্মি অফিসার ও সৈনিক যারা আছেন, তাদের ধর্মীয় আচার-আচরণকেও নির্মূল করা সম্ভব এবং তাদের ইসলামভীতিতে রাখা যায়। তোমরা বেশি নামাজ পড়লে তোমাদের কিন্তু মেজর জিয়াউলের মতো অবস্থা করবÑওদের জন্য এটা খুব সহজ ছিল।
জিয়াউল বলেন, ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা স্তম্ভ মানুষের ইসলামি মূল্যবোধ এবং দেশপ্রেমিক ও ধর্মপ্রাণ সেনাবাহিনী দুটোকেই কিন্তু দুর্বল করা যায় এই জঙ্গি ট্যাগ বা ওয়ার অন টেররের বয়ানে। এভাবেই আমার ওপর একটির পর একটি ট্যাগ দেওয়া হয়েছিল।
যারা অভ্যুত্থান চেষ্টা করেছিলেন, তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে জিয়াউল বলেন, ৬০-৭০ জনকে তো ক্লোজ করা হয়। তাদের অনেকেরই পরে প্রমোশন হয়নি। পাঁচ-ছয়জনকে চাকরি থেকে বের করে দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, তারা তো অনেক সাজানো মামলায় আমার নাম জড়িয়েছে। আমি আইনগত পদক্ষেপ নেব। আইনি লড়াই চলবে। পাশাপাশি বর্তমান সরকার রাজনৈতিক মামলা রিভিউ করছে। সেখানে আমি আমার আইনজীবীর মাধ্যমে আবেদন করেছি। সেই আবেদনে আমি বিস্তারিত দেখিয়েছি। আমার মামলা যে রাজনৈতিক, সেই আবেদনে আমি তা পরিষ্কার করেছি।
Leave a Reply