শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ইতিহাসের এমন এক মহানায়ক, যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি স্থাপন থেকে শুরু করে রাষ্ট্র গঠনের প্রতিটি স্তরে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর নাম যেমন মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে, তেমনি রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁর প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক উদারতা এবং উন্নয়নমূলক দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের ইতিহাসে তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। ১৯৩৬ সালের আজকের দিনে বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার নশিপুর ইউনিয়নের বাগবাড়ী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামের এই সাহসী সূর্যসৈনিক।
মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অমর বীর। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক জান্তার আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণা জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে একত্রিত করে। তিনি জেড ফোর্স গঠন করে সাহসিকতার সঙ্গে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলে নেতৃত্ব দিয়ে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের ভিত্তি স্থাপন করেন।
তিনি ছিলেন রণাঙ্গনের বীর যোদ্ধা, সম্মুখযুদ্ধে এগিয়ে যাওয়া সাহসী নেতা। জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে মেজর জিয়া একাধিক কৌশলগত যুদ্ধ পরিচালনা করেন। কামালপুর, নকশী, এবং ঘাসিপুরের মতো যুদ্ধে তাঁর সাহসিকতা এবং দূরদর্শী নেতৃত্ব শত্রুর মনোবলে আঘাত হানে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবলকে চাঙ্গা করে। এসব যুদ্ধ কেবল মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় নিশ্চিত করেনি, বরং আত্মত্যাগ এবং দেশপ্রেমের অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছে।Tourism guides
মেজর জিয়ার কৌশল এবং নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অভিযান, যেমন চিলমারী, সালুটিকর, এবং ধলাই চা-বাগানের লড়াই, তাঁকে ইতিহাসে এক অতুলনীয় যোদ্ধা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর বীরত্ব, কৌশলগত পরিকল্পনা, এবং নেতৃত্বের দক্ষতা মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের “বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ” একটি যুগান্তকারী ধারণা, যা জাতির পরিচয়ে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের পর বিভক্ত জাতি যখন একটি ঐক্যবদ্ধ পরিচয়ের সন্ধানে ছিল, তখন জিয়া তাঁর সাহসী নেতৃত্বের মাধ্যমে জাতিকে একটি বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গি উপহার দেন। তাঁর বক্তব্য—“আমরা ধর্মে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান; ভাষায় বাঙালি, কিন্তু একত্রে আমরা বাংলাদেশি”—জাতির আত্মপরিচয় ও ঐক্যের ভিত্তি রচনা করে। এই ধারণা জাতিগত, ধর্মীয়, এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সমন্বয়ে একটি সম্পূর্ণ জাতির পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছে। স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে তাঁর নেতৃত্ব, বিশেষত চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা, জাতিকে এক অভিন্ন লক্ষ্যে একত্রিত করেছিল।
শহীদ জিয়ার আদর্শ ও নেতৃত্ব সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন দেখায়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে একটি জাতির শক্তি তার বৈচিত্র্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ধারণা, যা ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের বোধ সৃষ্টি করে। এটি কেবল রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়; বরং এটি একটি ইতিহাস, যা জাতিকে স্বাধীনতার আদর্শে উজ্জীবিত করে এবং আজও আমাদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে আছে।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা কর্মসূচি বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক মুক্তি ও স্বনির্ভরতার একটি অনন্য মাইলফলক। ১৯৭৭ সালে এই কর্মসূচি ঘোষণার মাধ্যমে তিনি দেশকে দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, এবং বৈষম্যের বেড়াজাল থেকে মুক্তির পথ দেখান। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মতো উদ্যোগ দেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার ভিত্তি স্থাপন করে। তাঁর নেতৃত্বে কৃষি ও শিল্প খাতের উন্নয়নে নেওয়া পদক্ষেপগুলো যেমন অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে, তেমনই সামাজিক ন্যায্যতা নিশ্চিত করে একটি সামগ্রিক উন্নয়নের দিশা দেখায়। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণে তিনি উন্নয়নকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর করে তোলেন।
শুধু দেশীয় উন্নয়ন নয়, জিয়াউর রহমানের পররাষ্ট্রনীতি ও আঞ্চলিক সহযোগিতার উদ্যোগও ১৯ দফা কর্মসূচিকে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করে। ইন্দো-সোভিয়েত বলয়ের বাইরে চীন, জাপান, এবং মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপন ও শ্রমশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে তিনি অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করেন। দক্ষিণ এশিয়ায় সহযোগিতার ভিত্তি স্থাপনের ক্ষেত্রে সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কোঅপারেশন (SAARC) গঠনে তাঁর দূরদর্শী ভূমিকা আঞ্চলিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তাঁর ১৯ দফা কর্মসূচি কেবল অতীতের জন্য নয়, বরং আজও সমান প্রাসঙ্গিক—জাতীয় ঐক্য, টেকসই উন্নয়ন, এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটি এক অনুপ্রেরণার মশাল।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেন। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন। তাঁর উদ্যোগে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বাড়ানো হয় এবং দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নতুন মাত্রা যোগ করা হয়। বিরোধী দলগুলোর অধিকার নিশ্চিত করতে তিনি উদার মনোভাব প্রদর্শন করেন, যা গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। শহীদ জিয়ার হাতে গড়া এই সংগঠন তাঁরই আদর্শে বেড়ে উঠে বাংলাদেশের উন্নয়ন উৎপাদন স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য সর্বদা লড়াই করেছে। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গনমানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতি নতুন গতি লাভ করে। তাঁর “খাল কাটা” কর্মসূচি ছিল কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর ফলে সেচ ব্যবস্থা উন্নত হয় এবং কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে। এছাড়া গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে তিনি গ্রামের অর্থনীতি সচল করেন।
শিল্প ও বাণিজ্য খাতেও শহীদ জিয়া নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রবর্তন করেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বিকাশে নীতি গ্রহণ করে তিনি দেশের উৎপাদন খাতকে শক্তিশালী করেন। এ সময়ে তিনি গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশে উৎসাহ প্রদান করেন, যা পরবর্তীতে দেশের প্রধান রপ্তানি খাতে পরিণত হয়।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের নীতিমালা ছিল আত্মনির্ভরশীলতা এবং বহুমুখী উন্নয়ন। তিনি কৃষি, শিল্প এবং বাণিজ্যের সমন্বিত উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করান।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি নতুন পরিচিতি লাভ করে। তার দূরদর্শী পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনৈতিক দক্ষতায় বাংলাদেশ বিশ্ব মঞ্চে মর্যাদার আসন দখল করে। জাতিসংঘে তার বক্তব্য থেকে শুরু করে তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্য বিমোচনে ১০ দফা কর্মসূচি, ইরান-ইরাক যুদ্ধ নিরসনে শান্তি প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা, এবং মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের জন্য নিবেদিত প্রচেষ্টা—সবকিছুতেই জিয়া বাংলাদেশকে গর্বিত করেছিলেন। সৌদি বাদশাহকে নিম গাছ উপহার দেওয়ার মাধ্যমে কৌশলগত বন্ধুত্বের একটি প্রতীকী উদাহরণ তৈরি করেছিলেন তিনি। বাদশাহ খালিদ বিন আব্দুল আজিজের সঙ্গে সাক্ষাতে তিনি বলেছিলেন, “আপনার দেশে যা অভাব, তা আমাদের দেশে প্রচুর,” যা দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার এক নতুন পথ উন্মোচন করে।
আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে জিয়ার দর্শন দক্ষিণ এশিয়ার সহযোগিতামূলক কাঠামো প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক ভিত্তি তৈরি করে। সার্ক প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তার ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির ফল, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে দারিদ্র্য ও অনুন্নয়ন মোকাবিলায় একত্র হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বন্ধুত্ব, সহযোগিতা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া জিয়ার নীতির অন্যতম সাফল্য। তার কৌশলী নেতৃত্ব ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি আজও আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।
শিক্ষা খাতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অবদান ছিল অপরিসীম। তিনি মেয়েদের জন্য এসএসসি পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়ার ব্যবস্থা করেন এবং উপবৃত্তি চালু করেন। স্বাস্থ্যখাতেও তাঁর সময়ে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধিত হয়।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শুধু একটি নাম নয়, বরং একটি অধ্যায়। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে দৃঢ় ভিত্তি লাভ করে। তাঁর উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড, গণতান্ত্রিক উদারতা এবং জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিভঙ্গি আজও কোটি মানুষের হৃদয়ে জীবন্ত।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অবদান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অনুপ্রেরণা। তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তোলার পথে আমাদের অগ্রসর হতে হবে, যাতে দেশ একটি সুখী, সমৃদ্ধ এবং মর্যাদাশীল রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে গড়ে উঠবে সত্যিকারের বাংলাদেশ।
Leave a Reply