ক্লাসের সেরা ছাত্র বলা যায় তাকে। প্রতিটি ক্লাস টেস্টে সর্বোচ্চ নম্বর পায় সে। কিন্তু ফাইনাল এলেই কী জানি হয়ে যায়। ডাহা ফেল মেরে বসে। ক্রিকেটের দুনিয়ায় এই ভালো ছাত্রটিই যেন দক্ষিণ আফ্রিকা। ক্রিকেটের সবচেয়ে শক্তিশালী দলের একটি তারা, সারা বছর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে প্রতিপক্ষকে গুড়িয়ে দেয় তারা। অথচ আইসিসির বৈশ্বিক কোনো টুর্নামেন্টের নকআউট পর্বে নামলেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে প্রোটিয়ারা।
আরও একবার ‘চোকার্স’ খেতাবটার যথার্থতার প্রমাণ দিল দক্ষিণ আফ্রিকা। গতকাল শনিবার (২৯ জুন) ভারতের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টির ফাইনালে জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও শেষ পর্যন্ত ৭ রানে হেরে গেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। ক্রিকেটের দুই ফরম্যাটের যেকোনো বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো ফাইনালে ওঠা প্রোটিয়াদের শেষ পাঁচ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল মোটে ৩০ রান। হাতে ছিল ৬ উইকেট। অথচ হঠাৎ পথ হারিয়ে হেরে বসে তারা। চাপের মুখে ভেঙে পড়ার বদনাম এবারও ঘুচাতে ব্যর্থ প্রোটিয়ারা।
ক্রিকেটবিশ্বে চোকার্স নামটা দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে। খেলার জগতে চোকার্স বলতে এমন ব্যক্তি বা দলকে বোঝায়, নির্দিষ্ট সময়ে যাদের কাজ বা আচরণ পূর্বানুমিত কিংবা প্রত্যাশিত। নকআউট ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার ভেঙে পড়ার ঘটনা বহুবার ঘটেছে। বলা চলে, আইসিসির যে কোনো প্রতিযোগিতায় দুয়েকটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে বরাবরই এমনটা ঘটেছে।
সেই ম্যাচে ব্রায়ান লারার দুর্দান্ত সেঞ্চুরিতে ৮ উইকেট হারিয়ে ২৬৪ রান করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জবাবে ব্যাট করতে নেমে এক পর্যায়ে ৪ উইকেটে ১৮৬ রান তুলে ফেলে তারা। কিন্তু সেখান থেকে পথ হারিয়ে ম্যাচ হেরে বিদায় নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা।
তখন থেকেই বড় ম্যাচে প্রোটিয়াদের ভেঙে পড়ার ঐতিহ্য নজর কাড়ে বাকিদের। আর চোকার্স নামটা আসে সম্ভবত অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ’র কাছ থেকে। একটা সময় প্রতি বছরের শেষভাগে অস্ট্রেলিয়াতে ত্রিদেশীয় একটা টুর্নামেন্ট হতো। ১৯৯৭-৯৮ সালে সেই টুর্নামেন্টের তিনটি দল ছিল অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা আর নিউজিল্যান্ড। সেবার গ্রুপ পর্বে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে চার ম্যাচেই জয় পায় দক্ষিণ আফ্রিকা। গ্রুপ পর্বে আট ম্যাচে শুধু নিউজিল্যান্ডের কাছেই এক ম্যাচে হেরেছিল তারা। ফের ফাইনালে মুখোমুখি হয় অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা।
সেই সিরিজের ফাইনাল ছিল তিন ম্যাচের সিরিজ। সেখানে প্রথম ম্যাচ জিতে এগিয়ে যাইয় দক্ষিণ আফ্রিকা। সিরিজ জয় তখন সময়ের ব্যাপার বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু অজি অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ সংবাদ সম্মেলনে বললেন, অস্ট্রেলিয়া এই সিরিজ জিততে চলেছে। কারণ হিসেবে তিনি বললেন, বড় ম্যাচে নার্ভ ধরে রাখতে প্রোটিয়াদের ব্যর্থতার কথা। চাপের মুখে তাদের ভেঙে পড়ার উদাহরণ হিসেবে টানলেন ১৯৯৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের কথা। সবাই ভেবেছিল, এটা বাকপটু অস্ট্রেলিয়ার কথার লড়াইয়ে জড়ানোর জন্যই বলা। কিন্তু দেখা গেল, সত্যি সত্যি ফাইনালের বাকি দুই লেগে প্রোটিয়াদের হারিয়ে শিরোপা জিতে নিলো অস্ট্রেলিয়া।
এরপর থেকেই চোকার্স খেতাবটা দক্ষিণ আফ্রিকার নামের সঙ্গে জুড়ে গেল। গ্যারি কারস্টেন, হার্শেল গিবস, হ্যান্সি ক্রোনিয়ে, অ্যালান ডোনাল্ড, শন পোলকের প্রজন্ম থেকে শুরু করে গ্রায়েম স্মিথ, জ্যাক ক্যালিস, এবি ডি ভিলিয়ার্স, ডেল স্টেইন, কিংবা হালের রাবাদা, মার্করাম, ক্লাসেন – কেউই চোকার্স বদনামটা প্রোটিয়াদের গা থেকে সরাতে পারেনি। কখনো বৃষ্টি আইনে, কখনোবা রানরেটের হিসেব ভুল করার চক্করে, কখনো নার্ভ হারিয়ে পাগলাটে দৌড়ে পথ হারানোটাই যেন তাদের নিয়তি।
এবার মার্করামের নেতৃত্বে খুব কাছে পৌঁছেও পারল না তারা। অপরাজিতভাবে ফাইনালে এসে ভারতের বিপক্ষে জয়টা হাতের মুঠোয় পুরতে পুরতেই হঠাৎ ফেলে দিল মার্করামের দল। প্রমাণ করে দিল- চোকার্সরা বদলায় না।
Leave a Reply