free tracking

সাফল্যের পেছনের গল্প শোনালেন মেডিকেলে চান্স পাওয়া ইমা!

অভাব-অনটনের সংসারে শুধুমাত্র ইচ্ছাশক্তি দিয়েই মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন অদম্য মেধাবী ইমা আক্তার। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় (পিএসসি) তে জিপিএ-৫ না পেয়ে ভেঙে পড়লেও তার ইচ্ছাশক্তি আর দিনরাত কঠোর পরিশ্রমের ফলে জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন।

এরপর স্বপ্ন পূরণে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে। এমন সাফল্যের পেছনে সর্বত্র সাহস জুগিয়েছেন তার মা-বাবা।

শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) দুপুরে একান্ত আলাপকালে সাফল্যের পেছনের গল্প তুলে ধরেন ইমা আক্তার। এখন তার স্বপ্ন মানবিক চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা। হতে চান গরিবের চিকিৎসক, যেখানে হতদরিদ্র মানুষ পাবেন বিনামূল্যে চিকিৎসা। এজন্য সকলের সহযোগিতা ও দোয়া কামনা করেছেন তিনি।

ইমা আক্তার ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার পৌর এলাকার ৫নং ওয়ার্ড পূর্ব হাসামদিয়া গ্রামের মুদি দোকানদার শেখ বিলাল হোসেনের কন্যা। তিন বোনের মধ্যে সে সবার বড়। ভাঙ্গা সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পান। পরে ফরিদপুর সরকারি সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন।

শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে ইমাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজনরা ভিড় করছেন। তার অভূতপূর্ব সাফল্যে আবেগাপ্লূত বাবা-মা সহ সকলে। তাদের বাড়িতে পৌঁছাতেই মিষ্টিমুখ করান বাবা শেখ বিলাল হোসেন।

এরপর কথা হয় ইমার সাথে। ইমা বলেন, ‘আমার জার্নিটা এতটা সহজ ছিল না। যখন আমি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি তখন আমার জিপিএ-৫ আসছিল না। সব বন্ধু-বান্ধব জিপিএ-৫ পেয়েছিল, অনেকে ট্যালেন্টপুলি বৃত্তি পেয়েছিল। তখন কান্না করলেও আমার মা-বাবা অনেক সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। এরপর থেকেই ভালো কিছু করার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যেন আমার বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল হয়। তখন থেকে আমি ভালো বন্ধুদের সাথে মেশার চেষ্টা করতাম, ওরা কীভাবে পড়ালেখা করে সেটা দেখতাম। ওরা অনেক প্রাইভেট পড়ত। কিন্তু আমার বাবা মুদি দোকানি হওয়ায় সেভাবে খরচ দিতে পারত না। তখন বন্ধুদের কাছ থেকে নোট নিয়ে পড়ালেখা করতাম। এরপর অষ্টম শ্রেণির জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে যাই। ওই ফলাফল আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। যার কারণে পরবর্তী পরীক্ষাগুলোতে জিপিএ-৫ পেয়েছি। উচ্চ মাধ্যমিক পড়ালেখায়ও নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে।’

ফরিদপুর শহরের সরকারি সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজে পড়ালেখার সুযোগ হলেও একমাত্র বাবার আয়ে শহরে থাকাটাও চ্যালেঞ্জিং ছিল তার জন্য।

ইমা বলেন, ‘বাবা সেভাবে খরচ দিতে না পারায় এক সময় প্রাইভেট পড়া বন্ধ হয়ে যায়। তখন বাসায় থেকেই পড়ালেখা শুরু করি। কখনও বাবা-মাকেও বলতাম না যে আমার প্রাইভেট পড়তে হবে। বাসায় পড়ালেখার পাশাপাশি মোবাইল দিয়ে বিভিন্ন টিউটোরিয়াল ক্লাসের ভিডিও দেখতাম। এভাবে কষ্ট করেই পড়ালেখা করতে হয়েছে।’

মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার জন্য সহপাঠীরা বিভিন্ন নামি-দামি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হলেও সেই সৌভাগ্যটা হয়নি ইমার। বাসায় বসেই মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। দিনরাত কঠোর পরিশ্রম শেষে শহরের একটি কোচিং সেন্টারে শুধু পরীক্ষা দেন এবং সেই পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জন করেন। তখন ওই কোচিং সেন্টার থেকে তাকে অ্যাওয়ার্ডও দেয়া হয়। এরপর মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দেন ইমা। সে ফলাফলে মেধা তালিকায় ২০০৩ নম্বরে জায়গা করে নেন, সুযোগ হয়ে যায় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তির।

ইমা বলেন, ‘মেডিকেলে চান্স পেয়ে অনেক খুশি হয়েছি, আনন্দে দীর্ঘক্ষণ কান্নাও করেছি। কারণ, জীবনে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। ইমা মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করে বলেন, মহান আল্লাহ তালা সব সময় আমার পাশে ছিলেন। সেই সাথে সব সময় আমার বাবা-মা পাশে থেকেই সাহস যুগিয়েছেন। আজ তাদের কারণেই আমি মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছি।’

একজন মানবিক চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করে ইমা বলেন, ‘ভবিষ্যতে যেন ভালো একজন চিকিৎসক হতে পারি, সেই দোয়া কামনা করি সকলের কাছে। আমি যেন বিনামূল্যে গরিব মানুষের সেবা করতে পারি এবং একজন গরীবের চিকিৎসক হতে চাই। এছাড়া ভবিষ্যতে দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর কথাও জানান ইমা।’

মেয়ের এমন সাফল্যে বাবা মুদি দোকানদার বিল্লাল হোসেন সমাজের সবার সাহায্য কামনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ের সাফল্যের খবর পেয়ে অনেকে খোঁজখবর নিচ্ছেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার, থানার ওসি সহ এলাকার সকলে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। সবশেষ ভাঙ্গা থানার ওসি মো. মোকছেদুর রহমান স্যারের সহযোগিতায় ব্রিটিশ-বাংলা ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট নামে একটি সংগঠন আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তারা আমার মেয়ের পড়ালেখার দায়িত্ব নেয়ার কথা জানিয়েছেন।’

এদিন দুপুরে তাদের বাড়িতে হাজির হোন সংগঠনটির প্রতিনিধি দল। এ সময় ইমার বাবার হাতে আর্থিক অনুদানও তুলে দেন।

সংগঠনটির প্রতিনিধি মো. সানজিদ ফেরদৌস নিশু বলেন, ‘আর্তমানবতা সেবায় একঝাক প্রবাসী ভাইদের সহযোগিতায় গঠিত আমাদের সংগঠন। সংগঠনটি সারাবিশ্ব ব্যাপী আর্তমানবতার সেবায় কাজ করে যাচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় ইমার সাফল্যের খবর পেয়ে আমরা পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। তার পড়ালেখার সকল খরচের দায়িত্ব আমরা নেব। সে যদি উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে চায় সেক্ষেত্রেও সহযোগিতা করা হবে।’

ভাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোকছেদুর রহমান বলেন, ‘আমার থানা এলাকার মেয়েটির এমন সাফল্যে আমরা গর্বিত। সারাক্ষণ তার খোঁজ খবর নিচ্ছি। আমার পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব সেভাবে ইমার পাশে থাকব।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *