সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘমেয়াদী ঘুমের ঘাটতি মস্তিষ্কের প্রতিরক্ষা কোষগুলোর অতিসক্রিয়তা সৃষ্টি করে, যা দীর্ঘমেয়াদে মস্তিষ্কের ক্ষতির কারণ হতে পারে। মস্তিষ্কের গ্লিয়াল কোষগুলো সাধারণত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার কাজ করে, কিন্তু ঘুমের অভাবে এগুলো অত্যধিক সক্রিয় হয়ে ওঠে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ঘুম-বঞ্চিত ইঁদুরের ক্ষেত্রে এস্ট্রোসাইট নামক কোষগুলো, যেগুলো সাধারণত অপ্রয়োজনীয় স্নায়ু সংযোগ বা সিন্যাপ্স অপসারণের কাজ করে, তারা অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে মস্তিষ্কের প্রয়োজনীয় সংযোগ ও আবর্জনাগুলোও ভেঙে ফেলে।
শুরুতে এটি মস্তিষ্কের জন্য উপকারী মনে হলেও, কারণ এটি ক্ষতিকর আবর্জনা পরিষ্কার ও পুরনো স্নায়ুগুলো পুনর্গঠনে সহায়ক হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। কারণ, মাইক্রোগ্লিয়াল কোষগুলো, যেগুলো মস্তিষ্কের মৃত কোষ ও অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান সরিয়ে ফেলার কাজ করে, দীর্ঘমেয়াদী ঘুমের অভাবে অতি সক্রিয় হয়ে ওঠে।
এটি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক, কারণ অতিরিক্ত মাইক্রোগ্লিয়াল সক্রিয়তা বিভিন্ন স্নায়বিক রোগের সঙ্গে যুক্ত, যেমন আলঝাইমার এবং অন্যান্য নিউরোডিজেনারেটিভ রোগ।
গবেষণায় উঠে এসেছে যে ঘুমের অভাবের কারণে এস্ট্রোসাইট কোষগুলো মস্তিষ্কের স্নায়ুগত সংযোগ ও ধ্বংসাবশেষ বেশি পরিমাণে খেয়ে ফেলে। বিশেষত, ঘুমের অভাবে বেশি ব্যবহৃত বড় ও পরিণত সিন্যাপ্সগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তবে এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি, পর্যাপ্ত ঘুম পুনরুদ্ধার করলে এই ক্ষতি কি পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব কিনা। গবেষণাটি ব্যাখ্যা করে কেন ঘুমের অভাব ডিমেনশিয়া ও অন্যান্য স্নায়বিক ব্যাধির ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৯৯৯ সালের পর থেকে আলঝাইমারে মৃত্যুর হার ৫০% বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ঘুমের অভাব ও স্নায়বিক রোগের মধ্যে সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। ঘুম মস্তিষ্কের সুস্থতা ও কার্যকারিতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ঘুমের সময় মস্তিষ্ক নিজেকে মেরামত করে, সারা দিনের কর্মপ্রক্রিয়ার ফলে জমে থাকা বিষাক্ত বর্জ্য পরিষ্কার করে এবং স্মৃতিগুলো সংরক্ষণ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, ঘুমের অভাব মনোযোগের ঘাটতি, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা হ্রাস এবং মানসিক কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। দীর্ঘমেয়াদী ঘুমের অভাব নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারে, বিশেষ করে আলঝাইমার রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
ঘুমের মাধ্যমে নতুন শিক্ষাগ্রহণ ও স্মৃতি গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় স্নায়ু সংযোগ শক্তিশালী হয়, পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় সংযোগ অপসারণ করা হয়, যা মস্তিষ্ককে কার্যকরভাবে পরিচালনার সুযোগ দেয়। মস্তিষ্কের গ্লিম্ফাটিক সিস্টেম, যা মস্তিষ্ক থেকে বর্জ্য পদার্থ অপসারণ করে, তা ঘুমের সময় বিশেষভাবে সক্রিয় থাকে। ফলে ঘুমের অভাবের কারণে এই প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে স্নায়ুগত রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
ঘুম মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে ব্যক্তির মধ্যে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, স্ট্রেস বেড়ে যায় এবং মানসিক চাপের প্রতিক্রিয়া তীব্র হয়। এছাড়া, মস্তিষ্কের নমনীয়তা বা নতুন অভিজ্ঞতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাও ঘুমের মাধ্যমে বৃদ্ধি পায়, যা শেখার দক্ষতা ও নতুন দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
ঘুমের বিভিন্ন পর্যায় বিভিন্ন কাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, REM (Rapid Eye Movement) ঘুম সৃজনশীলতা ও আবেগ প্রক্রিয়াকরণের জন্য প্রয়োজনীয়, অন্যদিকে স্লো-ওয়েভ ঘুম স্মৃতি সংরক্ষণ ও শারীরিক পুনরুদ্ধারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও, ঘুম হরমোন নিয়ন্ত্রণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা ক্ষুধা, মানসিক চাপ ও শারীরিক বৃদ্ধির ওপর প্রভাব ফেলে। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ঘুমের অভাব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকেও দুর্বল করে দেয়, যার ফলে ঘুম-বঞ্চিত ব্যক্তিরা সহজেই বিভিন্ন সংক্রমণ ও অসুস্থতায় আক্রান্ত হতে পারেন।
ঘুম শুধু বিশ্রামের সময় নয়, এটি মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বজায় রাখা, নতুন অভিজ্ঞতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া এবং দীর্ঘমেয়াদী সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য। ঘুমের অভাব শুধু অস্থায়ী ক্লান্তির কারণ নয়, বরং এটি দীর্ঘমেয়াদে মারাত্মক স্নায়বিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, এমনকি মস্তিষ্ক নিজেই নিজেকে ধ্বংস করতে শুরু করতে পারে।
তাই সুস্থ ও দীর্ঘমেয়াদী মস্তিষ্কের কার্যকারিতার জন্য নিয়মিত পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
সূত্র: সায়েন্স মিউজিয়াম অব ভার্জিনিয়া
Leave a Reply